আগষ্টের বন্যা ২০২৪

দেশ একটা সংকটময় সময় পার করছে। সদ্য এক সরকারের পতন হয়েছে ছাত্র জনতার বিপ্লবে। কার্যত আইন আদালত সব থমকে গেছে। প্রথম কদিন গেলো ডাকাতের কবলে। রাত হলেই "বর্গি এলো দেশে"র মত করে শহরের অলিগলিতে এদের উপদ্রব শুরু হলো। কিন্তু ঠেকিয়ে দিলো জনতা। তারা রাত জেগে পাহারা দিতে লাগলো নিজেদের এলাকা। একতাই বল। 

নৈতিক মনোবল হারানো পুলিশ রাস্তায় না থাকলেও জনতা জাগ্রত।

ডাকাত ধরার পর মাইর, এরপর শুরু হলো অভিনব কায়দায় মানসিক টর্চার। ডাকাতদের বেশিরভাগই যেহেতু ইয়াং বয়সের, তাদের দিয়ে নাচ-গানের প্রতিযোগিতা চালালো এই জেনারেশন। বাংলাদেশ আসলেই অদ্ভুত। বুড়োদের মাঝে আতংক আর কিশোর-যুবকেরা ব্যপারটাকে উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে গেলো।

আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে ফেইসবুকে এইসব ভিডিও দেখলাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাকাতের জন্য মায়াও লাগল। এরা নিশ্চয়ই এইরকম পরিস্থিতিতে পড়বে সারাজীবনেও তা কল্পনা করেনি।

Bangladesh is absolute cinema.

এরপর আবার পুরনো রুপে ফিরে এলো আন্দোলন। এতদিন যারা কোন দাবি জানায়নি এবার তারাও প্রতিদিনই কোন না কোন দাবি নিয়ে ঢাকার রাস্তা দখল করতে লাগল। গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদাবাজেরা আবার শুরু করল হুমকি ধামকি। আর্মি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এই অভিশাপ আবার শুরু হবে এতে কোন সন্দেহ নাই। ছাত্ররা একসময় ঘরে ফিরে যাবে, নিজের পড়াশোনায় মন দেবে। এই পরজীবীরা তখন আবার দেশের আনাচে কানাচে ভরে যাবে।

অগাষ্টের শেষে এসে আবার সমস্যায় পড়ল দেশ। চরমভাবে বন্যায় আক্রান্ত হল ফেনী, নোয়াখালী এবং সিলেট অঞ্চল। অতিবৃষ্টি আছেই, সেই সাথে আছে বর্তমানে দায়িত্ব নেয়া প্রশাসনের অদক্ষতা। ভারত তার বাঁধ খুলে দিতে বাধ্য হওয়ায় বন্যার তীব্রতা আরো বাড়ল।

অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এই বন্যার পূর্বাভাস কিন্তু অনেক আগে থেকেই ছিলো। কিন্তু দেশের এই ডামাডোলে কেউ নজর দেয়নি। ভারত বিরোধিতা যেহেতু অনেক আগে থেকেই আছে দেশে, তাই ফেইসবুক ছেয়ে গেলো ভারতকে দোষ দেয়াতে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কোন বাঁধ দিয়ে এই পরিমান পানি আটকে রাখা সম্ভব না। 

উজানের দেশ ভারত থেকে ভাটির দেশ বাংলাদেশে পানি আসবেই ফিজিক্সের সূত্র মেনে। ওখানে বন্যা হলে এখানেও বন্যা হবে। আটকানোটা প্রায় অসম্ভব।

দোষ দেয়া বন্ধ করে আমাদের উচিৎ নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বন্যার্তদের সাহায্যে। দ্বিধাবিভক্ত বাঙ্গালী আবারো এক হয়েছে। Absolute সিনেমার মত করে তারা ত্রান সংগ্রহ করছে, উদ্ধারকারী দল পাঠাচ্ছে, টাকা-খাবার সব কিছুই যাচ্ছে। হতাশ হতে গিয়েও তাই মাঝে মাঝে আবার আশার আলো দেখি এই জাতির জন্য।

 

ভাটির দেশ হবার কারনে আমাদের দেশে প্রতি দশ বছর পরপর ভয়াবহ বন্যা হবেই। আমাদের দরকার প্রস্তুতি নেয়া। ফেইসবুকে অনেক ফেইক ছবির ভীড়ে উপরের এই ছবি আমার মনে দাগ কেটেছে। এই শিশু যখন বড় হবে, সে কি জানবে তাকে সুস্থ অবস্থায় দেখে কত কত মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। কি ভীষণ একটা গোলমেলে সময়ে তাকে রক্ষা করা হয়েছে?

তরুণদের দখলে থাকা দেশে, তাদের অভিজ্ঞতার অভাব থাকলেও সদিচ্ছার অভাব দেখছি না। এটাই হওয়া দরকার ছিলো। পথ হারিয়োনা বাংলাদেশ। জিও-পলিটিক্সের প্যাঁচে আর ব্যক্তিগত স্বার্থের গোলকধাঁধায় অনেক দেশই বসন্তের পর ডুবে গেছে ঘোর অমাবস্যায়। বিপদের সময় যারা কাছে আসে, মধুর কথা বলে, এরা সবাই বন্ধু নয়। রাস্তায় মিছিল করা আর দেশ চালানো এক বিষয় নয়। দরকারে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।

মনে রাখতে হবে- People are judged by their action, not by words or religion. যে বাক স্বাধীনতার কথা বলার আশায় জনতা বুক বেঁধেছে, সংস্কারের নামে নিজেরাই সেটার গলা টিপে ধরবেন না।

আমাদের দেশে দুই রকমের লোক আছে, সবকিছুকেই রাজনৈতিক রুপ দেয়া আর সবকিছুকেই ধর্মীয় রুপ দেয়া লোক। এরা বাংলাদেশের দূর্যোগকে রাজনৈতিক বলবে আর পাশের দেশের দূর্যোগকে খোদার অভিশাপ নামে চালিয়ে দেবে। কেউ মনে রাখে না, প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া করে ভাল থাকা যায় না। 

আমার মাঝে মধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কেন ইউরোপের মত বর্ডার পাই না? ব্যক্তিগতভাবে বর্ডারের ধারনাটাই আমার পছন্দের না। তারপর হঠাৎ করে মনে হয়, এই জনপদের লোকগুলো আসলে উন্মাদ শ্রেণীর। ধর্মীয় বিভাজনকে যারা সবকিছুর উর্ধ্বে রাখে তারা কোনদিন "Open Border" এর ধারনা কল্পনাও করতে পারবে না। এদের জন্য ভালো জিনিস উপভোগ করতে ইউরোপ ভ্রমণই একমাত্র উপায়।

ফেইসবুক মূলত মূর্খ আর বাচাল লোকজনে ভরা। ইদানিং তাই ফেইসবুকে ঢু মারা কমিয়ে দিয়েছি। নিজের মনের কথা লিখলেও লোকজনের আঁতে ঘা লাগে। বাকস্বাধীনতার কথা মুখে বললেও আমরা খুব কম সময়েই বিরোধী পক্ষকে বলতে দেই, আর শুনতে পছন্দ করি। এখনও পর্যন্ত চিন্তার উন্মেষ খুব কমই দেখেছি এই দেশে। 

লেখালেখির জন্য কোন জাতি যদি মানুষ খুন করতে পারে, তবে তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। সেখানে বাক স্বাধীনতা নেই। সব অভিমতকে স্বাগত জানাতে হবে। যুক্তি খন্ডন করতে হবে যুক্তি দিয়ে, জ্ঞান কে জ্ঞান দিয়ে। তলোয়ারের ডগায় বা বন্ধুকের নলে ক্ষমতা বদল হলেও, তা ক্রমাগত নতুন নতুন বিপ্লবের জন্ম দেবে। আর প্রতিটি রাজনৈতিক বিপ্লব দেশকে দশ বছর করে পিছিয়ে দেবে।


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন