ঘৃণার শহর এবং আমাদের অবিশ্বাস
ঘৃণা অত্যন্ত ব্যাক্তিগত একটি বিষয়। আপনি কাকে ঘৃণা করবেন সেটা নির্ভর করে তার দ্বারা আপনার কি পরিমানে ক্ষতি হচ্ছে সেটার উপর।
অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, মানুষই বোধহয় একমাত্র প্রজাতি যারা শারীরিক ক্ষতির আশংকা না থাকা স্বত্তেও অন্যপ্রজাতি বা অন্য মানুষকে ঘৃণা করে শুধুমাত্র বিশ্বাসের বলি হয়ে।
বিশ্বাসের ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। মানব সভ্যতার প্রায় পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। সেই শুরু থেকেই মানুষ উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছে আমরা কে, এবং কোথা থেকে এসেছি? সেই উত্তর খুঁজতে যেয়ে এসেছে নানা ধরনের ধর্ম বিশ্বাস। চাঁদ, সূর্য আর সমুদ্রকেও সৃষ্টিকর্তা ভেবেছে একসময় মানুষ।
মানুষের চিন্তার উন্মেষ তখন খুব বেশি ছিলো বলে মনে হয়না। চোখের সামনে নিজের থেকে বড় যা কিছুই দেখেছে তাতেই ঈশ্বরের ছায়া দেখতে পেয়েছে।
প্রাচীন গ্রীকদের কথা যদি ধরি - সমুদ্র দেবতা পসাইডেন ছিলেন তাদের বিশ্বাসের অংশ। তখন জিউস শাসন করতেন মাউন্ট অলিম্পাস থেকে। তিনি মানব জাতির পিতাও বটে। আর তার ভাই হেডিস ছিলেন পাতালপুরির নিয়ন্ত্রন কর্তা। এক জটিল পারিবারিক নিয়মে পৃথিবীর ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রিত আর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল গ্রীকবাসী।
গ্রীকদের সমসাময়িক কালে আরো যারা পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল তাদের নিজেদেরও অনেক দেবদেবী ছিলো। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবেই অনেক ঈশ্বরের উপাসনা করা হত। গোত্র, পরিবার এবং একটা সমাজের আকারের উপর নির্ভর করত কাদের দেব-দেবী বেশি শক্তিশালী। খোদ মক্কার কাবা ঘরেই একশর মত মূর্তি ছিল। এমনকি এদের অনেকের নামও ছিলো না।
প্রাচীন ব্যাবিলনের কথাই বলি, তাদের মতে দেবতা এনলিল জীবন্ত প্রানী তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন। এনলিল ছিলো স্বর্গ আর পৃথিবীর স্রষ্টা। তিনি মানুষ তৈরির কাজ দিয়েছিলেন জ্ঞানের দেবতা এনকি'কে। আরেক দেবী নিনহারসাগ (Ninhursag) দেবতাদের আদলে মানুষের মুর্তি তৈরি করেছিলেন মাটিতে ঢালাই করে। এরপর এনলিলের রক্ত এই মূর্তিকে জীবন এবং জ্ঞান দিয়েছিল।
সৃষ্টিজগতকে ব্যাখ্যা করার এই সকল প্রাচীন চেষ্টা থেকেই উদ্ভব হয়েছে নানা ধরনের বিশ্বাস আর ধর্মের। এই বিশ্বাসগুলোই নিয়ন্ত্রন করত তখনকার সমাজব্যবস্থা আর গোত্রীয় বা রাষ্ট্রীয় আইন।
এত কথা বলার মানে হল, বিশ্বাস সমসময়ই মানব সভ্যতার গুরুত্বপুর্ন চালিকা শক্তি ছিলো। এই বিশ্বাসের বলি হয়েই যুদ্ধ হয়েছে, রাষ্ট্র ভেঙ্গেছে, গড়েছে, মানব হত্যা হয়েছে, ইতিহাসের পট পরিবর্তন হয়েছে।
একেশ্বরবাদের ধারনা এসেছে আরো অনেক পরে। যখন মানুষের সভ্যতা একটা শক্ত ভিত পেয়েছে তখন। বিশ্বাসকে তারা একটা যৌক্তিক আদল দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বাস যেমন সভ্যতা গড়েছে তেমনি ধ্বংসও করেছে।
বর্তমানের আধুনিক মানুষও কিন্তু বিশ্বাসের এই খেলা থেকে মুক্ত নয়। তবে চিন্তার উন্মেষ ঘটার কারনে আমাদের বিশ্বাস আরো বিস্তৃত হয়েছে। আমরা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশ্বাস করি, আইনে বিশ্বাস করি। ধর্মে বিশ্বাস করে ভালবাসি বা ঘৃণা করি।
এত এত কাল্পনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর ভর করেই। এগুলো সভ্যতার দিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখছে।
টাকার কথাই ধরুন। টাকা বর্ডার ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রুপে আছে। কিন্তু এর একটা বৈশ্বিক রুপান্তর আছে। পৃথিবীর এক দেশের মুদ্রা আপনি অন্যদেশের মুদ্রায় রুপান্তর করতে পারবেন। কোন দেশের মুদ্রা কতটা রুপান্তর করা যায় তা নির্ভর করে একটা রাষ্ট্র কতটা শক্তিশালি তার উপর।
বর্তমান পৃথিবীতে আমেরিকান ডলার সবচেয়ে বেশি রুপান্তর সক্ষম মুদ্রা। কারন পৃথিবী বিশ্বাস করে আমেরিকা সামরিক শক্তিতে একটা সুপারপাওয়ার।
টাকা দিয়ে আপনি অন্য যে কোন জিনিস কিনতে পারেন, কারন মানুষ বিশ্বাস করে এই কাগজের জিনসটার একটা বিনিময় মূল্য আছে। এই বিশ্বাসের পেছনে কারন ব্যাংক, রাষ্ট্র এবং সামরিক শক্তি।
বন্ধুকের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। যতক্ষন পর্যন্ত না তা ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষ সেটাকে ভয় পায় এবং সমীহ করে। তার দৃঢ় বিশ্বাস থাকে বন্দুক সমাজ এবং ব্যাক্তিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। এই বিশ্বাসই মুল শক্তি। এর ফলে যা হয়, মাত্র ২ লক্ষের মত সৈনিক দিয়ে আপনি ২০ কোটি জনগণকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন।
যখন এই বিশ্বাস (ভয়) ভেঙে যায়, তখন মাত্র অল্প কিছু পুলিশ আর সেনাবাহিনী দিয়ে দেশের জনগনকে নিয়ন্ত্রন করা যায় না।
এদেশে ২০২৪ সালে তাই হয়েছে। মানুষের ভেতরের বিশ্বাসটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার ভালো চায় এই বিশ্বাসে ঘুন ধরেছিল আরো অনেক আগেই। আগুনটা জ্বলেছে ২০২৪ এর জুলাইতে এসে।
এখন আমরা কার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। বিরোধী মতে বিশ্বাসী লোকজন একে অপরকে হত্যা করছে। এমনকি সরকার পতনের পরও খুন খারাবি বন্ধ হয় নাই। দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ হত্যা চলছে।
ধর্মে ঘোরতর অবিশ্বাসী লোকজনও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে চায়, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে আস্থা রাখতে চায়। রাষ্ট্র যেমন একটা কাল্পনিক বিশ্বাসের উপর ভর করে চলে, আমাদের আইন আদালতও তাই। আমরা মানুষেরা নিজেরাই কিছু নিয়ম কানুন বানিয়েছি যেন জোর যার মুলুক তার এই সত্য থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা যায়।
একটা রাষ্ট্র তখনই ভেঙে পড়ে যখন আমাদের বানানো সংবিধান আর আইনের প্রতি আমাদের বিশ্বাস দূর্বল হয়ে যায়। আমরা এখন সেই অবস্থায় আছি। এই বিশ্বাস পুনরায় কিভাবে বাড়ানো যায় সে চেষ্টা না করলে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিলিন হয়ে যাবে।
ঘৃনা ব্যক্তিগত এবং এর উৎপত্তি বিশ্বাস থেকে। যেহেতু আইনের প্রতি আর বিশ্বাস নেই, শ্রদ্ধাও নেই। তাই চোর সন্দেহে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলাটা যায়েজ। দালাল, আওয়ামীলীগ বা রাজাকার সন্দেহে মানুষ হত্যা করাও যায়েজ। পুরোটাই নির্ভর করে আপনি কি মানবতায় বিশ্বাস করেন নাকি জাস্টিস অন দ্যা স্পটে বিশ্বাস করেন তার উপর।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ৭০ হাজার রাশিয়ান যোদ্ধা মারা গেছেন। এদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এরা যুদ্ধে গেছে একটা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই বিশাল অংকের মানুষের মৃত্যুতে মানবজাতির কোন উপকার হয়নি। পুরো পৃথিবী জুড়েই চলছে এই বিশ্বাসের দ্বন্দ।
এটা কি কোনদিন বন্ধ হবে?
ইতিহাস যদি ভবিষৎবাণী করতে পারে, তবে সেই ধারা অনুযায়ি মানুষ একে অপরকে হত্যা বন্ধ করবে না। সর্বদাই তারা বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাস করে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হবে এবং নিজ প্রজাতি হত্যাকে অনুমোদন দেবে।
গতকালকের থেকে আজ বা আগামীকাল ভালো যাবে এই বিশ্বাসে বেঁচে থাকা লোকগুলো এখন ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে না। তাদের সামনে কোন কিছুর উপর আস্থা আর বিশ্বাস রাখার অবস্থা নেই। এরা প্রচন্ড পরিমানে হতাশ আর খুনি হবে। আদিম বিশ্বাসে ফেরত যাবে, মব জাস্টিস অনুমোদন করবে।
সবাই কিন্তু মানুষ, তারপরেও সে অন্য আরেক মানুষের ক্ষতি করে বা মেরে ফেলে শুধু মাত্র কোন একটা আদর্শ আর বিশ্বাসের বলে।
সমাধান কি?
সমাধান আছে যুক্তিতে। জগতের কোন উপকার না হলে আপনি মানুষ হত্যা করবেন না। না ব্যাক্তি না রাষ্ট্র, কাউকেই মানুষ হত্যার অনুমোদন দেয়া যাবে না। সে জন্যে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাটা খুব জরুরী। নয়ত এই সাপ কোন একদিন আপনাকেই কামড়ে দেবে।
অশিক্ষিত/কুশিক্ষিত মানুষ যৌক্তিক নয়। তার যত সম্পদ আর ডিগ্রিই থাকুক না কেন, সে ভয়ংকর। আমাদের দেশ ইউরোপ বা কানাডা হবে না। বরং আমরা পালিয়ে গিয়ে ওইসব দেশে আশ্রয় নেবো। কারন ওই অঞ্চলের লোকজন শিক্ষিত এবং তাদের সমাজ ব্যবস্থা আমাদের থেকে উন্নত। চিন্তা, চেতনা আর নতুন আবিষ্কারে আমাদের থেকে তাদের যোজন ব্যবধান। এরা কিন্তু ধর্মের বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে এই রকম সমাজ ব্যবস্থা বানায়নি।
আরেকটা জিনিস মনে করিয়ে দেয়া দরকার, দরিদ্র্য এবং চিন্তা ভাবনায় অনগ্রসর সমাজেই কিন্তু ধর্মীয় ভয় এবং বিশ্বাসের বেশি প্রচলন থাকে। বাংলাদেশেও তাই চলে। ধর্ম একটা নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা, কিন্তু যখন আপনার রাষ্ট্র তার থেকে উন্নত ব্যবস্থা প্রদান করতে পারবে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ধর্মীয় আইন গৌন হয়ে যাবে। ইউরোপের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। সেখানে ধর্ম আনুষ্ঠানিক রুপে আছে, কার্যত সমাজে এর প্রয়োগ আর আচরন কম।
আমরা বর্ণবাদকে ঘৃণা করি। কিন্তু বিয়ের সময় সাদা চামড়া খুঁজি। আমরা সব মানুষ সমানের কথা বলি, কিন্তু ধর্মের কারনে কারো বাসায় আগুন দিতে দ্বিধা করি না। আমরা গণতন্ত্রের বুলি আওড়াই, কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিশ্বাস করি না। অদ্ভুত এক অন্ধকারে ডুবে থাকা জাতি আমরা।
বাক স্বাধীনতা চাই বটে, কিন্তু বিরুদ্ধ মতকে স্বাগত জানাতে আমাদের শেখানো হয় না। এদেশে গণতন্ত্র এখনো আসেনি, কারন অযৌক্তিক আর কুশিক্ষত মানুষ দিয়ে দেশটা ভরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা আর গবেষণা বাদে আর সব কিছুই হচ্ছে। নেতাদের মিছিল হচ্ছে, মানুষ খুন হচ্ছে, কাওয়ালি হচ্ছে, মিলাদ মাহফিল হচ্ছে। একটা সভ্য জাতির জন্য যা যা দরকার, তার বেশিরভাগ উপকরণই আমাদের নেই।
মেধাবী হবার আগে মানুষ হতে হয়, মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন