আমাদের বিজ্ঞানচিন্তা এবং সাংবাদিকতা

আমেরিকা পৃথিবীর সবথেকে বড় দেশ নয়, বোধহয় চতুর্থ হবে, এমনকি জনসংখ্যার দিক থেকেও সে সবার উপরে নেই। সবচেয়ে বেশি ধার্মিকও সেখানে নেই, তাহলে কোন ক্ষমতাবলে সে পৃথিবীর উপরে ছড়ি ঘোরাচ্ছে? সহজ উত্তর হচ্ছে তার প্রযুক্তি এবং সামরিক সক্ষমতায়।

এই দুটো বিষয় আবার নির্ভর করে বিজ্ঞানের পেছনে একটা দেশ কত খরচ করে তার উপর। তার মানে ধরে নেয়া যায় আমেরিকা বিজ্ঞান গবেষনার পেছনে প্রচুর খরচ করে। 

আরেকটু বিশদভাবে বললে আমেরিকান কালচারে বিজ্ঞান এবং শিক্ষার পেছনে খরচ করার মানসিকতা আছে। কালচারের কথা বলছি কারন যেকোন দেশের রাজনীতি, আইন আর স্কুলগুলোর পড়াশোনা নির্ভর করে সেখানকার সংস্কৃতি আর বিনোদনের উপর।

আমি যখনই কোন সায়েন্স-ফিকশন মুভি দেখি, সেখানে আমেরিকানদের উপস্থিতি দেখি। বিগ-ব্যাং থিওরি একটা কমেডি টিভি সিরিজ। কয়েকজন তত্ত্বীয় বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের ল্যাব এবং ল্যাবের বাইরের জীবন সেখানে দেখানো হয়েছে। সিরিজটা এতই মজার আর কমিক রিলিফে ভরা যে যতবার দেখি ভালো লাগে। প্রচুর মানুষ অনুপ্রানিত হয়েছে বিজ্ঞানকে নতুন ভাবে ভালোবাসতে এই সিরিজ দেখে।

সে দেশে কার্ল-সাগান এক জনপ্রিয় নাম। তার হাত ধরে কত শত বাচ্চারা বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দেখেছে। তাদের মিচিও কাকু এখনো টিভিতে বিজ্ঞানের কঠিন সব বিষয়গুলোকে তুলে আনছেন ফ্যান্টাসি গল্পের মত করে। নেল ডেগ্রেস টাইসন এর পডকাস্ট আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা দেখতে পারবেন বোর হওয়া বাদে।

কি বুঝলেন? এরা শুধু মারামারির মুভি বানায় না, বরঞ্চ বিজ্ঞানকে ভালোবাসা তাদের সংস্কৃতির একটা অংশ বানিয়ে ফেলেছে। সায়েন্টিস্টরা সেখানে সেলিব্রেটির মর্যাদা পায়। 

ইলন মাস্কের কথাই ধরুন, আজকে দেখলাম তার কোম্পানি স্পেস-এক্স একটা রকেট লাঞ্চিং এর পর আবার ডকিং স্টেশনে এসে বুস্টারকে ল্যান্ড করিয়েছে। এ লোকটা কিন্তু ফিল্মস্টার বা ক্রিকেটার নয়, সে ইঞ্জিনিয়ার। বলা হয়ে থাকে আয়রনম্যান মুভিতে টনি স্টার্ক আসলে তাকে পোট্রে করেছে। সত্যি-মিথ্যা জানি না। 

বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে যদি আপনার সংস্কৃতির অংশ বানিয়ে ফেলেন তবে লাখ লাখ স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাকে আপনি অনুপ্রানিত করতে পারবেন ভবিষ্যতে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করার জন্য।

আমাদের দেশে সাই-ফাই লেখক খুবই কম। জাফর ইকবাল, হুমায়ূন আহমেদ বাদে বাকি অনেকের লেখাতেই আমি সেই ফ্যান্টাসি খুঁজে পাইনি যেটা একটা বাচ্চাকে অনুপ্রানিত করতে পারে। সত্যজিৎ রায়ের লেখা বিজ্ঞান গল্প, অথবা প্রফেসর শুঙ্কুও আমাকে অনেক আন্দোলিত করেছে ছোটবেলায়। 

বিজ্ঞান নিয়ে টিভি সিরিজ বানানো অনেক দুরের কল্পনা আমাদের জন্য। আমাদের টিভি সিরিজগুলো পড়ে আছে রোমাঞ্চ, খুন-খারাবি আর সস্তা প্রেমের ডায়লগ নিয়ে। আমাদের মা-বাবারা ব্যস্ত থাকেন ভারতীয় সিরিয়াল আর মুভি নিয়ে। শাহরুখ, সালমান আর দিপীকার নাম আমাদের বাচ্চাদের মায়েরাও জানেন।

এদেশে সাংবাদিকরা পড়ে আছে কে কোথায় হেলিকপ্টার বানালো, তেল বাদে বাইক কিভাবে চালালো এইগুলার নিউজ নিয়ে। সংবাদপত্র চাইলে যেকোন জিনসকে জনপ্রিয় করতে পারে যদি তারা চায়। টিভি আর সংবাদপত্র যদি সুডো-সাইন্সের চর্চা করে তবে ভরসা কার উপর রাখা যায়?

ওয়াজ মাহফিল শুরু হলো বলে, শীতকাল আসন্ন প্রায়। এটা এখন আমাদের কালচারের অংশ হয়ে গেছে। আমরা উন্নত হতে চাই, কিন্তু সেই মানসিকতার বীজ বপন করতে চরম অনীহা। আমরা কোটি টাকা খরচ করে পর্নস্টার, নায়ক গায়ক ভাড়া করতে পারি, কিন্তু দেশের বা বিদেশের কোন বিজ্ঞানীকে হাইলাইট করতে চাই না। কিছু কালচার একদিনে হয় না, তাকে হওয়াতে হয়। বাঙ্গালী বিজ্ঞানীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবেন দেশের বাইরে, কারন সেখানে গবেষনার সুযোগ আছে, বোঝার আর এপ্রিশিয়েট করার মানসিকতা আছে।

আপনি যতক্ষন পর্যন্ত বাইকের ইঞ্জিন দিয়ে হেলিকপ্টার বানানোকে প্রশ্রয় দিয়ে যাবেন আমরা সেটা নিয়ে হাসাহাসি করেই যাবো। আগে এদের পড়াশোনার খোঁজখবর নিন। একাডেমিয়া একদিনে গজায় নাই। এরোন্যাটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আর স্পেস টেকনোলজি নিয়ে পড়তে বাচ্চাদের আগ্রহী করে তুলুন। এই সকল সুডো-সাইন্স দেখলেই ক্যামেরা নিয়ে হুজুগে চলে যাবেন না।

এবার দৃশ্যপট থেকে আমেরিকা শব্দটা বাদ দিন। অন্যকোন দেশের নাম বসিয়ে দিন। জাপান, চীন বা ভারতও হতে পারে। সুজ্যারল্যান্ড, জার্মানি, কানাডাও বসাতে পারেন। এদের সংস্কৃতিও একই রকম। যারাই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে তাদের কালচারের অংশ বানাতে পেরেছে তারাই উন্নতি করছে। এখানে গোপন কোন মন্ত্র নেই। আমরা আজকে থেকে শুরু করলে আমাদের ৫০ বছর লাগবে জাতিকে বদলে দিতে।

শুধু দয়া করে, লাইট বাল্ব আবার আবিষ্কারের চেষ্টা করবেন না। ওটা অপ্রয়োজনীয়, অহেতুক।


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন