পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন
Point of no return - এই কথাটা আমি প্রথম পড়ি ব্ল্যাকহোল নিয়ে পড়তে গিয়ে। ব্লাকহোল মহাবিশ্বের এমন একটা স্থান, যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এত বেশি যে সেটা টাইম-স্পেসের সাধারণ গাণিতিক সূত্রগুলোকে ভেঙে ফেলে। এই ব্ল্যাকহোল নামক স্থানের আশে পাশে ইভেন্ট হরাইজন নামের যে অঞ্চলটা আছে আমরা সে পর্যন্তই দেখতে পারি। এর পরে বা ব্ল্যাকহোলের ভেতরে দেখতে পারি না। কারন ইভেন্ট হরাইজন এর স্কেইপ ভেলোসিটি (Escape Velocity) আলোর গতির সমান। মানে সেখান থেকে বের হতে হলে কোন বস্তু বা তথ্যের আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ভ্রমন করতে হবে। যেহেতু সেটা আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বে সম্ভব নয় তাই, কোন কিছুই এই সীমারেখা অতিক্রম করলে আর ফেরত আসতে পারে না। এই জায়গাটাকে পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন বলে।
আমাদের জীবনেও এই পয়েন্ট অফ নো-রিটার্ন উপস্থিত, কিন্তু আমরা ক'জন সেটা জানি?
ছোট থেকে বড় হতে হতে আমরা নানা ধরনের ভুল করি। এই ভুল করেই মানুষ শেখে। কিন্তু একটা বয়সের পরে গিয়ে প্রতিটা ভুল আপনাকে ভোগাবে। কারন ভুল শোধরানোর সময় তখন আর থাকে না। ধরুন, আপনি ছয় বছর বয়সে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেন না। প্রথাগত শিক্ষায় গেলেন না, নিজের মত করে চললেন। বয়স যত বাড়বে, আপনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার সম্ভাবন তত কমবে। যদিও জীবন যাপন করতে শিক্ষা অপরিহার্য নয়, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে অশিক্ষিত হলে আপনার উন্নত জীবনের সম্ভাবনা কমে যাবে।
আপনি অস্বাস্থ্যকর খাবার খান, নানান রকম পেটের অসুখে ভোগেন, আবার ঠিক হয়ে যান। কিন্তু একটা সময় পরে আপনার শরীর নিজে থেকে আর এটা ঠিক করতে পারবে না। দরকার হবে ঔষধের। আর এর পরেও যদি আপনি শরীরের জন্য দরকারি খাবার না খেয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে যান, তবে এমন একটা সময় আসবে যখন কোন ঔষধই আর আপনাকে সুস্থ করতে পারবে না।
যারা মাদক নেয়, তারা কিছুদিন ভাল থাকে আবার কিছুদিন অসুস্থ হয়, কিন্তু একটা সময় গিয়ে তারা আর সুস্থ থাকতে পারে না। তাদের পক্ষে আর কখনই সুস্থ জীবনে ফেরা সম্ভব হয় না।
এই না ফিরতে পারাটাই হচ্ছে পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন। আপনার প্রতিটা ভুল আপনাকে এই বিন্দুর দিকে নিয়ে যেতে থাকবে একটু একটু করে। যারা ক্রমাগত ভুল করে যাবে তাদের পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে পোছে যাবার হার বেশি।
আপনার একটা ভুল সিদ্ধান্তের পর আশেপাশের অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, আপনার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় সব থেকে বেশি। যারা পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে পৌছে গেছেন তারা শুধু নিজেরাই ডোবেন না, সাথে আর বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ডোবেন। কারন একটাই, মায়া।
লজিক্যাল ডিসিশান হচ্ছে, পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে পৌছে যাবার পর সেই মানুষকে ত্যাগ করা। কিন্তু অনেক সময় আমরা সেটা মেনে নিতে চাই না আবেগের কারনে। ফিরে আসার ক্রমাগত চেষ্টায় সময় এবং আর্থিক অপচয় ঘটে।
মানব শরীর অত্যন্ত নাজুক একটা জিনিস। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন প্রনালীর কারনে আমরা ক্রমাগত পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে পৌছে যাই খুব দ্রুত। একটু একটু করে সময় যায় আর না ফিরতে পারার বিন্দুর দিকে আমাদের দেহ চলে যায়। যারা ব্যায়াম বা শারীরিক কোন পরিশ্রম করেন না, তারা যারা ব্যায়াম করেন তাদের তুলনায় রোগ-শোকে ভোগেন বেশি। একটা বয়সের পরে ব্যায়াম করার সামর্থ্য বা ইচ্ছা আর থাকে না। তখন বেঁচে থাকতে হয় নানা অসুখ আর ঔষধ নিয়ে।
যে কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাবার পরে প্রথমে অবিশ্বাস আসবে, যে এমন হতেই পারে না! তারপর আসবে ক্ষোভ, কেন আমার সাথেই এমন হল? এরপর আসবে মেনে নেয়া আর তারপর দুঃখ। কিন্তু যৌক্তিক বিষয় হচ্ছে, পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে পৌছে যাবার পর কোন কিছুতেই আর সেই ঘটনা পরিবর্তন করা যায় না। নিজের অবস্থা মেনে নেয়াটাই তখন সব থেকে উত্তম কাজ।
--
বেশিরভাগ মানুষ জানে না, কোন জিনিসই একদিনে বা হুট করে হয় না। সাম্রাজ্যের পতন, ব্যবসায় সাফল্য, কিংবা শরীর গঠন সব কিছুতেই একটা দীর্ঘ সময় লাগে। দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রমের পরে সাফল্য আসে। নতুন একটা ভাষা শিখতে যান, সেখানেও আপনাকে ব্যায় করতে হবে অনেক সময়। একটা শিশুও নিজের মায়ের ভাষা শিখতে তিন বছরের মত সময় নেয়।
পরিনত বয়সে যে ভুল করে ফেলেছেন সেটা অনেক সময় আর শোধরানো যাবে না। শোধরাতে গেলে নতুন নতুন ভুলের জন্ম হবে। যেটুকে সময় পাবেন এই পয়েন্ট অফ নো রিটার্নের পরে সেটা উপভোগ করার চেষ্টা করুন।
সময় খুবই দরকারি জিনিস, আপনার জীবনে সেটা সীমিত এবং যে কোন পরিমানে টাকা দিয়েও সেটা ফেরত পাওয়া যাবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন