বাক-স্বাধীনতার খাঁচা
পাখি দুই রকমের, একটা উড়তে পারে আরেকটা উড়তে পারে না। যারা উড়তে পারে না, তারা আবার খুব জোরে দৌড়াতে পারে। কোন না কোন ভাবে তাকে খাবার এবং আত্মরক্ষার ব্যবস্থা প্রকৃতি করে দিয়েছে।
এরা স্বাধীন পাখি। এদেরকে তোতা পাখির মত কথা শেখানো কঠিন বিষয়। কাছে গেলেই এরা উড়ে যায়। গাছের উঁচু ডাল থেকে নানা সুরে ডাকডাকি করে। মানুষের তোয়াক্কা করে না। আপনার শেখানো বুলি কোনভাবেই সে বলবে না। এরা বাকস্বাধীনতা উপভোগ করে।
কিছু পাখি আছে মানুষের খাঁচায় বসবাস করে। মূলত নিজের শখ পূরন করার জন্যই মানুষ তাকে বন্দী বানায়। নিজের মত খাবার দেয়, রংবেরঙের খাঁচা বানায়, বুলি শেখায়। তারপর জীবে প্রেম করেছে ভেবে খুব আহ্লাদ বোধ করে।
খাঁচার পাখি মাঝে মধ্যে ডানা ঝাঁপটায়, কপট রাগ দেখায়। কিন্তু তাকে তাই বলতে হয় আর করতে হয় যতটুকু তার খাঁচার মালিকের ইচ্ছা হয়। আর মাঝে মধ্যে শেখানো বুলি আওড়ে সে মালিককে খুশি রাখার চেষ্টা করে, যাতে ভালো খাবার পাওয়া যায়। এরা হচ্ছে বাক-পরাধীন পাখি। ডাকতে পারলেও খাবারের জন্য শেখানো বুলি বলতে হয় তাকে। নিজের ভাষার বদলে তাকে অন্য ভাষা রপ্ত করতে হয়।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে এই খাঁচায় বন্দী পাখির মতন। এরা মাঝে মধ্যে ডানা ঝাপটে কপট স্বাধীনতা উপভোগ করলেও মূলত বন্দী জীবন যাপন করে। সরকারের সীমার মধ্যে থেকেই সুশীলতা দেখায় আর নীতির চর্চা করে।
আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে, কেন আমাদের দেশের সাহিত্যিকেরা বিশ্বজয়ী সাহিত্যকর্ম তৈরি করতে পারে না? কারন বন্দি থাকা অবস্থায় তার আকাশে ওড়াওড়ি বন্ধ। কলমের গণ্ডি বেঁধে দেয়া আছে। কি লিখতে পারবে আর পারবে না সেটা যদি সীমারেখা টেনে দেয়া থাকে তবে সেখানে সাহিত্য চর্চা হয় না। যেটা হয় সেটা বাচ্চাদের গরু রচনা লেখার মত।
কিছু গৃহপালিত কবি-সাহিত্যিক অবশ্য প্রেমের গল্প আর কবিতা লিখেই জীবন পার করে দেয়। সমাজের দর্পন হবার বদলে তারা মিনমিনে সাহিত্য রচনা করে নারীকুলের ভালোবাসা অর্জন করে।
আবার কেউ কেউ যা হচ্ছে তা বলতে না পারার এই অদম্য বেদনায় পালিয়ে যায়, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে গিয়ে নির্বাসিত জীবন যাপন শুরু করে।
বাক-স্বাধীনতার চর্চা করার জন্য বাংলাদেশ কখনোই উপযুক্ত ছিলো না।এখানে কবি-সাহিত্যিকের কলমকে ক্ষমতাসীনরা চরম ভয় পায়। সংবাদপত্রে কোনটা প্রকাশ হবে আর লেখকেরা কি লিখতে পারবে সেটা যদি ঠিক করে দেয়া থাকে তবে সেখানে উৎকৃষ্ট চিন্তার প্রতিফলন হয় না।
আমাদের দেশে অবশ্য জনগনই অনেক সময় এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। লেখালেখির জন্য এখানে হামলা, মামলা এবং শেষ পর্যন্ত খুন করার নজীর আছে।
অথচ বয়ান বাজিতে সবাই বলে বেড়ায় খুব বাক-স্বাধীনতা উপভোগ করছি। গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীর ভীড়ে আসল লেখকেরা তাই হারিয়ে গেছেন।
নয়ত অনেক আগেই আপনি পত্রিকা আর ফেইসবুক ভরা দেখতেন, "যা হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে না"। লেখকেরা যদি সমালোচনা না করতে পারেন সমাজের, তবে সেই সমাজ পরিবর্তনের আশা করাটা বাতুলতা।
অপ্রিয় সত্য কথা বলতে পারাটাই বাক স্বাধীনতা। আপনার যা পছন্দ শুধু তাই যদি বলে যান লেখকেরা, তবে সেটা সৃষ্টিশীল নয়। সেখানে উঁচু মানের সাহিত্য রচনা হবে না।
এই চর্চা এদেশে আদৌ হচ্ছে কি? লেখককে প্রানে মেরে ফেলার হুমকি না দিয়ে এদেশের মানুষ কি তাদের লেখা পড়তে বা সমালোচনা শুনতে প্রস্তুত?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন