স্থায়ী ঠিকানা
একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কতবার বাসস্থান পরিবর্তন করে?
এই তথ্য আমাদের দেশে সংগ্রহ করা হয় না। আমি একটা অনুমান নির্ভর কথা বলতে পারি, প্রতি পাঁচ বা ছয় বছর পর পর মানুষ তার বাসা পরিবর্তন করে। বাসা পরিবর্তনের সাথে ব্যাক্তির পেশা বেশি জড়িত। গ্রামাঞ্চলের লোকজন যারা কৃষিকাজের সাথে জড়িত তারা সাধারনত বাসা পরিবর্তন করে না। নিজের কেনা সম্পত্তিতে বা বাসায় যারা থাকেন তারাও সহজে বাসস্থান পরিবর্তন করেন না।
বাসসস্থান পরিবর্তনের মূল কারন শিক্ষা এবং চাকরি। দেখা গেছে ছেলেকে পড়াশোনা করানোর জন্য বাবা তার বসত ভিটা ছেড়ে শহরে এসে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। নতুন চাকুরি পাওয়ার পর বা চাকুরিতে বদলি হলে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় সরে যেতে হচ্ছে লোকজনকে।
বাসা ভাড়াও বাসস্থান পরিবর্তনের কারনগুলোর একটা। শহরের পশ (posh) এলাকাগুলোতে বাসা ভাড়া বেশি। সেখানে রিকশাভাড়া, বাজারের খরচ এবং আনুষঙ্গিক খরচও বেশি হয়। মধ্যবিত্তরা সাধারণত সে এলাকায় বাসা ভাড়া নিতে পারেন না। সে সকল এলাকায় যারা থাকেন তাদের লাইফস্টাইল সম্পূর্ন আলাদা। যেমন আমাদের পুরান ঢাকা আর গুলশান এলাকায় বাসা ভাড়ার আকাশ পাতাল তফাত। দুই এলাকার সংস্কৃতিতেও পার্থ্যক্য আছে। পুরান ঢাকায় বা গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা কফিশপে বসে আড্ডা দেয়না, ছেলে বন্ধুর সাথে বসে স্মোক করে না, ধর্ম মেনে চলা বা না চলাটা তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। পোষাকের কারনে তাকে অযথা হেনস্থা হতে হয় না ইত্যাদি। একই শহর অথচ দুটো জায়গায় আপনি আলাদা রকমের স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবেন।
যারা সাধারনত একবার নিজের বাসা ছেড়ে চাকরি, ব্যবসা বা শিক্ষার কারনে অন্য জায়গায় থাকতে বাধ্য হন, তাদের দুইটা ঠিকানা থাকে। একটাকে তারা স্থায়ী আবাস, আরেকটাকে বর্তমান ঠিকানা বলেন। স্থায়ী আবাস বলতে মানুষ মূলত যেখানে জন্মগ্রহন করেছে বা বাপ-দাদারা থাকতেন সেই ঠিকানাটাকে বোঝাতে চান। যদিও আমি এই দুই ঠিকানার ঘোরতর বিরোধী।
বছরের তিনশত পয়ষট্টি দিনের তিনশ দিনই যদি চাকরি বা অন্য কারনে আপনাকে একটা নির্দিষ্ট স্থানে থাকতে হয় তবে সেটাই আপনার স্থায়ী আবাস। আপনার বাপ-দাদার ভিটাতে আপনি কদাচিৎ যান, সেখানে থাকেন না। আবার যখন যান তখন নিজেকে আর সেখানকার সংস্কৃতির সাথে মেলাতেও পারেন না। অতিথির মত যান আর কয়েকটা দিন থেকে ফেরত আসেন। সেটাকে শুধু এনআইডি আর পাসপোর্টে জন্মস্থান হিসেবে ব্যবহার করেন, এই জায়গা কোনভাবেই আপনার স্থায়ী ঠিকানা হতে পারেনা।
মানুষের আসলে স্থায়ী কোন ঠিকানা হয় না। আমি নিজেই আমার প্রতিটা পাসপোর্টে আমার স্থায়ী ঠিকানা একবার করে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। বেঁচে থাকতে যে আবার করবনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
খুব কম মানুষই আছেন যারা খুব পরিকল্পনা করে নিজের বাসস্থান বেছে নেন। বেশিরভাগ সময়েই তার চাকুরি বা ব্যবসাবৃত্তি তাকে বাধ্য করে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করতে। অনেকে আবার আবেগের কাছে হেরে যান এবং নিজের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত এলাকার মায়ার টানে পড়ে একই এলাকায় পড়ে থাকেন বছরের পর বছর।
বয়স ত্রিশ হবার আগেই আপনাকে যে সিদ্বান্তগুলো নিয়ে ফেলতে হবে তার একটা হচ্ছে "আপনি কোথায় থাকতে চান।" সেখানে ভাড়া বসায় থাকুন বা নিজের ফ্ল্যাটে, অথবা জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে, যাই করেন না কেন - আগে থেকেই ভেবেচিন্তে ফেলুন। কারন বাসস্থানের উপর নির্ভর করে আপনার তিনটা প্রধান চাহিদা পূরণ হবে, আপনার আয়, সন্তানের শিক্ষা এবং দরকারি স্বাস্থ্য সেবা।
এমন একটা এলাকায় থাকুন যেখান থেকে এই তিন সেবা এবং কর্মকান্ড আপনি সহজে পরিচালনা করতে পারেন। স্থায়ী ঠিকানার মোহে পড়ে থাকবেন না। যেখানে বছরে মাত্র অল্প কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাবেন সেটা কাগজে কলমে আপনার স্থায়ী ঠিকানা হলেও, নিজের মনে সেটাকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বিশ্বাস করা বাদ দিন।
আমি এমনকি উপদেশ দেই, যেখানে আপনি সারাবছর থাকেন না সে এলাকার কর্মকান্ডে কোন ধরনের ইনভেস্টমেন্টে না যেতে। যদি গ্রামে না থাকেন সারাবছর, সেখানে জমি কেনা বন্ধ করুন, সেখানে একতলা টিনের ঘরকে পাকা বানানো বন্ধ করুন। এই অর্থ ব্যবসা বা অন্যকোন জায়গায় খাটান।
এমন অনেকের সাথে কথা বলেছি, যারা ব্যবসা করেন শহরে, পরিবার নিয়ে এসেছেন এখানে থাকার জন্য, বাচ্চারা শহরের স্কুলে পড়ে, এখানকার সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে, কিন্তু গ্রামে তাদের অব্যবহৃত বাড়ি পড়ে আছে। অনেক জায়গা জমি আছে এবং বছর বছর সেই ব্যাক্তিরা বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা আর ঝগড়ায় জড়াচ্ছেন এই সকল সম্পত্তি নিয়ে। আয়ের থেকে ব্যয় আর সময় নষ্ট বেশি হচ্ছে এই সম্পত্তি সামাল দিতে গিয়ে।
এগুলো আসলে আপনার সম্পত্তি নয়, লায়াবিলিটি। যে ইনভেস্টমেন্ট বা প্রপার্টি আপনাকে আয় দেবে না সেটাই আপনার লায়াবিলিটি। বুদ্ধিমানেরা লায়াবিলিটি বাড়ায় না, মায়ায় পড়েও না। যে বিজনেস লাভের মুখ দেখছে না সেটা বন্ধ করে দেয়াটাই উত্তম। আবেগে পড়ে হাতি পোষার কোন মানে হয় না।
এই দেশে অবশ্য একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, স্থায়ী বাসস্থানের ঠিকানা বলে একটা অবান্তর জিনিস কাগজপত্রে উল্লেখ করতে হয়। এই নিয়মের পরিবর্তন করা দরকার। একজন ব্যাক্তির স্থায়ী ঠিকানা হবে তার দেশ। বৃহৎ পরিসরে আমি অবশ্য মানুষের তৈরি বর্ডার আর জাতীয়বাদী চিন্তারও বিরোধিতা করি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন