আধুনিক দাস ব্যবসা
বাংলাদেশে পড়াশোনা শেষ করতে করতে একটা ছেলের বয়স ২৭ পেরিয়ে যাওয়াটা অদ্ভুত নয়। এরপর চাকরি পেতে পেতে আরো এক-দু বছর। বাঙালীর গড় আয়ু হিসেব করলে জীবনের অর্ধেকটা সে ব্যয় করে ফেলে একটা নিরানন্দ মূলক কাজে। যারা পড়াশোনার মূল লক্ষ্য ধরে নিয়েছিল চাকরি পাবার আশায়, তাদের কৈশোর এবং যৌবনের একটা বড় অংশ চলে যায় অন্যের হয়ে দাসত্ব করতে গিয়ে।
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা আসলে দাস তৈরির কারখানা। নতুন কিছু শেখার আনন্দ থেকে শিশুদের এটা বঞ্ছিত করে। এদিক থেকে হিসেব করতে গেলে যারা ফেল মেরে জীবনের অন্যান্য কাজে বা ব্যবসায় মনোযোগ দেয় তারা বেশ ভাগ্যবান। তবে যারা বড় হয়েছে শুধুমাত্র একটা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করে জীবন পার করে দেবার জন্য, তারা মূলত আধুনিক দাস।
একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীতে দাস ব্যবসা অনেক লাভজনক ছিল। জাহাজে করে আফ্রিকা থেকে কালোদের কিংবা যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে আসা হত ইউরোপ, আমেরিকা এবং আরবে। মানুশকে পন্য হিসেবে বিক্রি করে দেয়া তখন সভ্য সমাজের একটা ব্যবসা ছিল। দাসেদের কোন ইচ্ছা ছিল না। বেঁচে থাকার বিনিময়ে তারা খাবার এবং বাসস্থান পেত। বিনিময়ে তাদের যেকোন কাজ করতে হত। রাস্তা বানানো, শহর বানানো, মনোরঞ্জনের জন্য হত্যা, সৈনিক হিসেবে - মোটামুটি সব কাজেই তাদের নিয়োগ করা হত। দাসদের কোন অভিজ্ঞতার দরকার ছিল না। মার খেতে খেতে শিখে যেত কিভাবে কাজ করতে হয়।
যুগ বদলেছে। মানুষ যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। মানবাধিকার নামে একটা কাল্পনিক বিষয়ের অবতারনা হয়েছে। চাইলেই কেউ আর এখন একটা মানুষ কিনে নিতে পারে না। এখনকার পুঁজিবাদি সমাজের কাজ করিয়ে নিতে কিছুটা শিক্ষিত আর ভদ্র দাসের দরকার। এরা যেন সহজে বিদ্রোহ না করে, স্বেচ্ছায় কাজ করে আর সময় মত কর্মস্থলে হাজিরা দেয় - ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত হওয়া দরকার।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাটা তৈরি হয়েছে সেরকম দাস বানাবার জন্য। এখানে যারা শিখতে আসে তাদের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হয় যেনতেন ভাবে একটা চাকরি পাওয়াকে। পড়াশোনা শেষে চাকরি পেলে তাই সে খুশিতে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, মিষ্টি খাওয়ায়।
আধুনিক দাসদের বন্দি করে রাখতে হয় না। তাকে মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমানে টাকা দিলে সে সময়মত পরিপাটি হয়ে, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ঠিক ঠিক চলে আসে নির্দিষ্ট জায়গায়। তাকে যাই বলেন সে মাথা পেতে নেয় ইয়েস বস বলে। সহজে বিদ্রোহ করেনা, কারন তাতে কাজ চলে যাবার ভয়। কাজ চলে গেলে বাসা ভাড়া, বাচ্চার স্কুলের বেতন, বাসার রেশন, ইলেক্ট্রিসিটি বিল এসব সে দিতে পারবে না। সভ্য সমাজে সে আর থাকতে পারবে না।
কি অদ্ভুত একটা প্রক্রিয়া না? শুধু সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, শেকলে বাঁধা দাসের শেকল এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু দিনের আলো সে বিক্রি করে দেয় আরেকজনের কাছে। তার পারিবারিক জীবন বলতে ঐ ছুটির দু'দিন।
যারা গবেষণা করার জন্য পড়াশোনা করে, কবি বা সাহিত্যিক হয়, বড় চিত্রকর হয়, সঙ্গীত কে ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দেয় এরা সমাজের খুব ছোট একটা অংশ। এরা আমার হিসেবের বাইরে।
সেদিন এক বন্ধুর সাথে কথায় কথায় বই পড়া নিয়ে কিঞ্চিত ঝগড়া হয়ে গেল। তাকে বলেছিলাম নিজের ধর্মগ্রন্থ বাদে কিছু বিজ্ঞানের বই, দর্শনের বই পড়তে। সে সাফ জানিয়ে দিল, এসব বই পড়ে বিজ্ঞানমনস্ক লোকজন যারা সাধারনত নাস্তিক হয়। তার এত বই পড়ার কোন ইচ্ছা নেই।
বই পড়ে মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য, নিজের চিন্তাকে পরিশীলিত করার জন্য, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবার জন্য। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন সেটা বাচ্চাদের ছোট থেকেই বই পড়ার প্রতি অনীহা তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এরা এমনকি নিজের ধর্মের ব্যপারেও খুব কম জানে। এদের ধর্মীয় জ্ঞানের বেশিরভাগই আসে অন্যের করা ওয়াজ থেকে।
যে বাচ্চাটা ঘাসের রঙ সবুজ কেন? আকাশে বিজলি কেন চমকায়? সূর্য কি আসলে জ্বলছে? - এরকম প্রশ্ন করত একসময়, স্কুল থেকে বের হয়ে সে বুঝে যায় জীবনে বড় হতে হলে বিসিএস পরীক্ষা দিতে হবে।
দাসেদের কারখানা একবার চালু হয়েছে, এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন দাস উৎপাদন করেই যাচ্ছে।
আমাদের মতন রাষ্ট্রের আসলে বুদ্ধিমান মানুষের দরকার নেই। তার দরকার সু-নাগরিক তৈরির একটা কারখানা। যেখান থেকে বছর বছর ট্যাক্স দিতে পারবে, আইন মেনে চলবে আর "যা বলব তাই শুনবে" এমন লোকজন বের হয়। তাই একটা তথৈবচ শিক্ষা ব্যবস্থায় ঢেকে দেয়া হয়েছে সবজায়গা। যারা পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে তারাই জীবনটাকে কিছুটা উপভোগ করতে পারছে।
পড়াশোনা করে শিক্ষিত হবার লক্ষ্যটা কি, সেটা বাচ্চাদের নতুন করে শিখিয়ে দেয়া দরকার। জীবনের লক্ষ্য উপভোগ করা, দাস হিসেবে নিজেকে স্বেচ্ছায় বিক্রি করে দেয়া নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন