পোস্টগুলি

সেপ্টেম্বর, ২০২৪ থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

বংশানুক্রমিক ঘৃণা

আমার কিছু ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি দুই ধরনের মানুষকে এড়িয়ে চলি। রাজনৈতিক আর ধার্মিক। এরা প্রচন্ড পরিমানে হিপোক্রেসি নিয়ে জীবন যাপন করে। 

রাজনীতি যারা করে তারা সত্য বলে না, চাইলেও বলতে পারে না। তবে লোকে এদের ভয় পায়, সমীহ করে কারন মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা এদের আছে।

আবার আশেপাশে, এমনকি নিজ পরিচিত জনের মধ্যেও যত ধার্মিক আমি দেখেছি তারা কেউই সৎ নয়। এরাও অনবরত মিথ্যা বলে এবং অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এরা মনে প্রচন্ড রকমের অস্বাস্থ্যকর একটা ঘৃণা নিয়ে জীবনযাপন করে।

কোন শিশুকেই আমি বর্ণবাদী আর ঘৃণা পোষন করতে দেখিনি। এরা সবার সাথে সমানভাবে মিশতে পারে। কিন্তু বড় হতে হতে এরা শিখে যায় কিভাবে একটা বিশেষ রঙকে ঘৃণা করতে হয়, কোন জাতিকে ঘৃণা করতে হয়। এই অসুস্থ মানসিকতা প্রাপ্তবয়স্করা শিশুদের মাঝে চালান করে। বংশানুক্রমে এই বিভাজনের খেলা চলছে।


বাঙ্গালীর রেসিজম

চিন্তা-ভাবনা করাটা কঠিন একটা কাজ। বেশিরভাগ মানুষ এই কাজে অক্ষম। তাই যে কোন ঘটনায় তারা হুট করে একটা সিদ্বান্তে চলে আসে, একটা রায় দিয়ে দেয়। এই রায়টা নির্ভর করে ব্যাক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা আর কি ধরনের তথ্য তার কাছে আছে সেটার উপর।

বাংলাদেশের মানুষ যে কোন ঘটনায় কোন ব্যক্তিকে যখন "খারাপ বা ভালো"র সনদ দেয়, তখন তারা দুটো জিনিসের পরিচয় দেয়, দলান্ধতা আর ধর্মান্ধতা।

আপনি কোন রাজনৈতিক দল করেন আর কোন ধর্মের অনুসারী, সেটার উপর নির্ভর করবে আপনি ভালো না খারাপ। সামষ্টিক ভাবে জাতি হিসেবে বাঙ্গালী খুবই উঁচু মানের রেসিস্ট। ব্যাক্তি বিশেষে অনেক ভালো মনের মানুষ আমি দেখেছি।

মহাশুন্যে পরান মাস্টার এবং মেঘ ও মেশিন

সৈয়দ শামসুল হক - আমি তাকে চিনি কবি হিসেবে। তার কোন কবিতা আমার মুখস্ত নেই। তবে অনেকগুলোই পত্রিকা মারফত পড়েছি। বিশেষ করে একটি কবিতার কথা আমার মনে আছে, "নূরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়" - নামে।

একটু কোট করা যাকঃ
 

অতি অকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি? কোন শব্দ? কিসের প্রপাত?
গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হয়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মানুষের বন্ধ দরোজায়।
এই তীব্র স্বচ্ছ পূর্ণিমায়
নুরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়।
কালঘুম যখন বাংলায়
তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আবার নূরলদীন দেখা দেয় মরা আঙিনায়।

এটা তার বিখ্যাত কবিতা। অনেকেই পড়েছেন।  

টিভিতে তিনি মাঝে মধ্যে আসতেন। কৈশোরে বিটিভিতে তার কবিতার আবৃত্তি শুনেছি। বিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালী কবিদের মধ্য তাকে আলাদা ভাবে চেনা যায়।

গল্পকার হিসেবেও তিনি সাবলীল। তবে তিনি যে সায়েন্স ফিকশনও লিখে গেছে সেটা আমার একদমই অজানা ছিল। সেদিন বেঙ্গল বইয়ে ঢু মারছিলাম, সময় পেলেই করি। বইয়ের গন্ধ আমার ভাল লাগে। সেখানেই হটাত করে নজরে আসে তার সায়েন্স ফিকশন সমগ্রতে।


 

"মহাশুন্যে পরান মাস্টার" এবং "মেঘ ও মেশিন" - এই দুটো গল্প আছে বইটিতে। সায়েন্স ফিকশন যে এমনও হতে পারে সেটা আসলে না পড়লে আমার জানা হতনা। 

মাটির কাছাকাছি গিয়ে গল্প বলা - এরকম ভাবে যদি বলি তবে বেশি বলা হবে না। খুব সাধারণ এক গ্রাম্য পাগলের গল্পকে নিয়ে গেছেন সমাজের একটা শক্তিশালী চিত্র তুলে ধরতে। সেখানে অভাব আছে, অভিযোগ আছে আর আছে আশার গল্প। অলৌকিক ভাবে ক্ষুধার সমস্যা সমাধানের গল্প।

পরের গল্প মেঘ ও মেশিনে তিনে আসলে নিজেকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন। নিজের চরিত্র এঁকেছেন এক কঠোর সমাজের মাঝখানে। যেখানে প্রেম, ভালোবাসা নাই, কবিতা, গল্প আর গান অনুপস্থিত। এরকম একটা সমাজে বিপ্লবের স্বপ্ন তিনি দেখেছেন সবজান্তা এক "মাইন্ড রিডার" মেশিনের হাত ধরে। যান্ত্রিক আর স্বার্থানেষী মহলের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি কিভাবে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন সেটাই মূল এই গল্পে।

গতানুগতিক সায়েন্স ফিকশন নয় এই দুটো গল্পের একটিও। যারা অতীত, ভবিষ্যত আর সময়ের রহস্য খুঁজে বেড়ান বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মাঝে এই বই তাদের ভালো লাগবে না।

সৈয়দ হক ভবিষ্যতের কথা বলেছেন ঠিকই কিন্তু আমি দেখেছি বর্তমান আর অতীতকে। সুখপাঠ্য নয়, তবে চিন্তার উদ্রেক করবে বইয়ের গল্প দুটো।

ঘৃণার শহর এবং আমাদের অবিশ্বাস

ঘৃণা অত্যন্ত ব্যাক্তিগত একটি বিষয়। আপনি কাকে ঘৃণা করবেন সেটা নির্ভর করে তার দ্বারা আপনার কি পরিমানে ক্ষতি হচ্ছে সেটার উপর।

অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, মানুষই বোধহয় একমাত্র প্রজাতি যারা শারীরিক ক্ষতির আশংকা না থাকা স্বত্তেও অন্যপ্রজাতি বা অন্য মানুষকে ঘৃণা করে শুধুমাত্র বিশ্বাসের বলি হয়ে।

বিশ্বাসের ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। মানব সভ্যতার প্রায় পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। সেই শুরু থেকেই মানুষ উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছে আমরা কে, এবং কোথা থেকে এসেছি? সেই উত্তর খুঁজতে যেয়ে এসেছে নানা ধরনের ধর্ম বিশ্বাস। চাঁদ, সূর্য আর সমুদ্রকেও সৃষ্টিকর্তা ভেবেছে একসময় মানুষ।

মানুষের চিন্তার উন্মেষ তখন খুব বেশি ছিলো বলে মনে হয়না। চোখের সামনে নিজের থেকে বড় যা কিছুই দেখেছে তাতেই ঈশ্বরের ছায়া দেখতে পেয়েছে। 

প্রাচীন গ্রীকদের কথা যদি ধরি - সমুদ্র দেবতা পসাইডেন ছিলেন তাদের বিশ্বাসের অংশ। তখন জিউস শাসন করতেন মাউন্ট অলিম্পাস থেকে। তিনি মানব জাতির পিতাও বটে। আর তার ভাই হেডিস ছিলেন পাতালপুরির নিয়ন্ত্রন কর্তা। এক জটিল পারিবারিক নিয়মে পৃথিবীর ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রিত আর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল গ্রীকবাসী।

গ্রীকদের সমসাময়িক কালে আরো যারা পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল তাদের নিজেদেরও অনেক দেবদেবী ছিলো। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবেই অনেক ঈশ্বরের উপাসনা করা হত। গোত্র, পরিবার এবং একটা সমাজের আকারের উপর নির্ভর করত কাদের দেব-দেবী বেশি শক্তিশালী। খোদ মক্কার কাবা ঘরেই একশর মত মূর্তি ছিল। এমনকি এদের অনেকের নামও ছিলো না।

প্রাচীন ব্যাবিলনের কথাই বলি, তাদের মতে দেবতা এনলিল জীবন্ত প্রানী তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন। এনলিল ছিলো স্বর্গ আর পৃথিবীর স্রষ্টা। তিনি মানুষ তৈরির কাজ দিয়েছিলেন জ্ঞানের দেবতা এনকি'কে। আরেক দেবী নিনহারসাগ (Ninhursag) দেবতাদের আদলে মানুষের মুর্তি তৈরি করেছিলেন মাটিতে ঢালাই করে। এরপর এনলিলের রক্ত এই মূর্তিকে জীবন এবং জ্ঞান দিয়েছিল।

সৃষ্টিজগতকে ব্যাখ্যা করার এই সকল প্রাচীন চেষ্টা থেকেই উদ্ভব হয়েছে নানা ধরনের বিশ্বাস আর ধর্মের। এই বিশ্বাসগুলোই নিয়ন্ত্রন করত তখনকার সমাজব্যবস্থা আর গোত্রীয় বা রাষ্ট্রীয় আইন।

এত কথা বলার মানে হল, বিশ্বাস সমসময়ই মানব সভ্যতার গুরুত্বপুর্ন চালিকা শক্তি ছিলো। এই বিশ্বাসের বলি হয়েই যুদ্ধ হয়েছে, রাষ্ট্র ভেঙ্গেছে, গড়েছে, মানব হত্যা হয়েছে, ইতিহাসের পট পরিবর্তন হয়েছে।

একেশ্বরবাদের ধারনা এসেছে আরো অনেক পরে। যখন মানুষের সভ্যতা একটা শক্ত ভিত পেয়েছে তখন। বিশ্বাসকে তারা একটা যৌক্তিক আদল দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বাস যেমন সভ্যতা গড়েছে তেমনি ধ্বংসও করেছে।

বর্তমানের আধুনিক মানুষও কিন্তু বিশ্বাসের এই খেলা থেকে মুক্ত নয়। তবে চিন্তার উন্মেষ ঘটার কারনে আমাদের বিশ্বাস আরো বিস্তৃত হয়েছে। আমরা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশ্বাস করি, আইনে বিশ্বাস করি। ধর্মে বিশ্বাস করে ভালবাসি বা ঘৃণা করি।

এত এত কাল্পনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর ভর করেই। এগুলো সভ্যতার দিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখছে।

টাকার কথাই ধরুন। টাকা বর্ডার ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রুপে আছে। কিন্তু এর একটা বৈশ্বিক রুপান্তর আছে। পৃথিবীর এক দেশের মুদ্রা আপনি অন্যদেশের মুদ্রায় রুপান্তর করতে পারবেন। কোন দেশের মুদ্রা কতটা রুপান্তর করা যায় তা নির্ভর করে একটা রাষ্ট্র কতটা শক্তিশালি তার উপর।

বর্তমান পৃথিবীতে আমেরিকান ডলার সবচেয়ে বেশি রুপান্তর সক্ষম মুদ্রা। কারন পৃথিবী বিশ্বাস করে আমেরিকা সামরিক শক্তিতে একটা সুপারপাওয়ার।

টাকা দিয়ে আপনি অন্য যে কোন জিনিস কিনতে পারেন, কারন মানুষ বিশ্বাস করে এই কাগজের জিনসটার একটা বিনিময় মূল্য আছে। এই বিশ্বাসের পেছনে কারন ব্যাংক, রাষ্ট্র এবং সামরিক শক্তি।

বন্ধুকের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। যতক্ষন পর্যন্ত না তা ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষ সেটাকে ভয় পায় এবং সমীহ করে। তার দৃঢ় বিশ্বাস থাকে বন্দুক সমাজ এবং ব্যাক্তিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। এই বিশ্বাসই মুল শক্তি। এর ফলে যা হয়, মাত্র ২ লক্ষের মত সৈনিক দিয়ে আপনি ২০ কোটি জনগণকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন।

যখন এই বিশ্বাস (ভয়) ভেঙে যায়, তখন মাত্র অল্প কিছু পুলিশ আর সেনাবাহিনী দিয়ে দেশের জনগনকে নিয়ন্ত্রন করা যায় না।

এদেশে ২০২৪ সালে তাই হয়েছে। মানুষের ভেতরের বিশ্বাসটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার ভালো চায় এই বিশ্বাসে ঘুন ধরেছিল আরো অনেক আগেই। আগুনটা জ্বলেছে ২০২৪ এর জুলাইতে এসে।

এখন আমরা কার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। বিরোধী মতে বিশ্বাসী লোকজন একে অপরকে হত্যা করছে। এমনকি সরকার পতনের পরও খুন খারাবি বন্ধ হয় নাই। দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ হত্যা চলছে।

ধর্মে ঘোরতর অবিশ্বাসী লোকজনও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে চায়, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে আস্থা রাখতে চায়। রাষ্ট্র যেমন একটা কাল্পনিক বিশ্বাসের উপর ভর করে চলে, আমাদের আইন আদালতও তাই। আমরা মানুষেরা নিজেরাই কিছু নিয়ম কানুন বানিয়েছি যেন জোর যার মুলুক তার এই সত্য থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা যায়।

একটা রাষ্ট্র তখনই ভেঙে পড়ে যখন আমাদের বানানো সংবিধান আর আইনের প্রতি আমাদের বিশ্বাস দূর্বল হয়ে যায়। আমরা এখন সেই অবস্থায় আছি। এই বিশ্বাস পুনরায় কিভাবে বাড়ানো যায় সে চেষ্টা না করলে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিলিন হয়ে যাবে।

ঘৃনা ব্যক্তিগত এবং এর উৎপত্তি বিশ্বাস থেকে। যেহেতু আইনের প্রতি আর বিশ্বাস নেই, শ্রদ্ধাও নেই। তাই চোর সন্দেহে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলাটা যায়েজ। দালাল, আওয়ামীলীগ বা রাজাকার সন্দেহে মানুষ হত্যা করাও যায়েজ। পুরোটাই নির্ভর করে আপনি কি মানবতায় বিশ্বাস করেন নাকি জাস্টিস অন দ্যা স্পটে বিশ্বাস করেন তার উপর।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ৭০ হাজার রাশিয়ান যোদ্ধা মারা গেছেন। এদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এরা যুদ্ধে গেছে একটা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই বিশাল অংকের মানুষের মৃত্যুতে মানবজাতির কোন উপকার হয়নি। পুরো পৃথিবী জুড়েই চলছে এই বিশ্বাসের দ্বন্দ।

এটা কি কোনদিন বন্ধ হবে?

ইতিহাস যদি ভবিষৎবাণী করতে পারে, তবে সেই ধারা অনুযায়ি মানুষ একে অপরকে হত্যা বন্ধ করবে না। সর্বদাই তারা বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাস করে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হবে এবং নিজ প্রজাতি হত্যাকে অনুমোদন দেবে।

গতকালকের থেকে আজ বা আগামীকাল ভালো যাবে এই বিশ্বাসে বেঁচে থাকা লোকগুলো এখন ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে না। তাদের সামনে কোন কিছুর উপর আস্থা আর বিশ্বাস রাখার অবস্থা নেই। এরা প্রচন্ড পরিমানে হতাশ আর খুনি হবে। আদিম বিশ্বাসে ফেরত যাবে, মব জাস্টিস অনুমোদন করবে।

সবাই কিন্তু মানুষ, তারপরেও সে অন্য আরেক মানুষের ক্ষতি করে বা মেরে ফেলে শুধু মাত্র কোন একটা আদর্শ আর বিশ্বাসের বলে।  

সমাধান কি?

সমাধান আছে যুক্তিতে। জগতের কোন উপকার না হলে আপনি মানুষ হত্যা করবেন না। না ব্যাক্তি না রাষ্ট্র, কাউকেই মানুষ হত্যার অনুমোদন দেয়া যাবে না। সে জন্যে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাটা খুব জরুরী। নয়ত এই সাপ কোন একদিন আপনাকেই কামড়ে দেবে।

অশিক্ষিত/কুশিক্ষিত মানুষ যৌক্তিক নয়। তার যত সম্পদ আর ডিগ্রিই থাকুক না কেন, সে ভয়ংকর। আমাদের দেশ ইউরোপ বা কানাডা হবে না। বরং আমরা পালিয়ে গিয়ে ওইসব দেশে আশ্রয় নেবো। কারন ওই অঞ্চলের লোকজন শিক্ষিত এবং তাদের সমাজ ব্যবস্থা আমাদের থেকে উন্নত। চিন্তা, চেতনা আর নতুন আবিষ্কারে আমাদের থেকে তাদের যোজন ব্যবধান। এরা কিন্তু ধর্মের বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে এই রকম সমাজ ব্যবস্থা বানায়নি।

আরেকটা জিনিস মনে করিয়ে দেয়া দরকার, দরিদ্র্য এবং চিন্তা ভাবনায় অনগ্রসর সমাজেই কিন্তু ধর্মীয় ভয় এবং বিশ্বাসের বেশি প্রচলন থাকে। বাংলাদেশেও তাই চলে। ধর্ম একটা নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা, কিন্তু যখন আপনার রাষ্ট্র তার থেকে উন্নত ব্যবস্থা প্রদান করতে পারবে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ধর্মীয় আইন গৌন হয়ে যাবে। ইউরোপের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। সেখানে ধর্ম আনুষ্ঠানিক রুপে আছে, কার্যত সমাজে এর প্রয়োগ আর আচরন কম।

আমরা বর্ণবাদকে ঘৃণা করি। কিন্তু বিয়ের সময় সাদা চামড়া খুঁজি। আমরা সব মানুষ সমানের কথা বলি, কিন্তু ধর্মের কারনে কারো বাসায় আগুন দিতে দ্বিধা করি না। আমরা গণতন্ত্রের বুলি আওড়াই, কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিশ্বাস করি না। অদ্ভুত এক অন্ধকারে ডুবে থাকা জাতি আমরা।

বাক স্বাধীনতা চাই বটে, কিন্তু বিরুদ্ধ মতকে স্বাগত জানাতে আমাদের শেখানো হয় না। এদেশে গণতন্ত্র এখনো আসেনি, কারন অযৌক্তিক আর কুশিক্ষত মানুষ দিয়ে দেশটা ভরা। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা আর গবেষণা বাদে আর সব কিছুই হচ্ছে। নেতাদের মিছিল হচ্ছে, মানুষ খুন হচ্ছে, কাওয়ালি হচ্ছে, মিলাদ মাহফিল হচ্ছে। একটা সভ্য জাতির জন্য যা যা দরকার, তার বেশিরভাগ উপকরণই আমাদের নেই।

মেধাবী হবার আগে মানুষ হতে হয়, মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হয়।


 


Atoms

আমরা কিছু অণুর সমষ্টি মাত্র, যারা অন্য অণুদের নিয়ে গবেষনা করছি। আমরা মহাবিশ্বের সেই অংশ যে নিজেই খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কে এবং কোথা থেকে এসেছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাবার পর সব কিছু জানা হয়ে যাবে এবং জগতের সব প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রকৃতি বারংবার বিভিন্ন প্রজাতি তৈরি করবে এই উত্তর খোঁজার জন্য।


 

 

আমরা বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণা করি

কবি-সাহিত্যিকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। যেহেতু তারা সৃষ্টিশীল মানসিক খোরাক উৎপাদনে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ধারনা তারা যাই প্রসব করবেন সেটাই পাচ্য।

পরিচিত কারো লেখা যদি ভাল না লাগে তাই চুপ থাকি। কি দরকার। কালের গর্ভে এমনিতেই সেটা হারিয়ে যাবে। যদি কারো অন্তঃসারশূন্য লেখাও ভালো না লাগে তবে সেটা বলা যাবে না। বললেই কাট্টি।

বাংলাদেশের বয়স খুব বেশি না। আমাদের বুদ্ধিজীবির সংখ্যাও হাতে গোনা। বিশাল বড় কোন দার্শনিকও আমাদের এখানে জন্মাননি যারা পৃথিবী ব্যাপ্তি নিয়ে আলোচনায় আছেন বা থাকবেন।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এরা নমস্য। এদের নিয়ে মাতম করা বাতুলতা। ছাগলের তিন নম্বরের বাচ্চার কাজ। সে জানে না তার কি করা উচিৎ, তাই অযথাই...। যারা নজরুল পড়েনি তারাও তাকে ভালবেসে নিজেদের দলে টানতে চায়। তিনি যে সেকুল্যার মতাদর্শের ছিলেন এরা সেটা অবিশ্বাস করে।

রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু ছিলেন না, বরঞ্চ ব্রাহ্ম ধর্মের মতানুসারী এরা তাও খতিয়ে দেখে না। ঘৃণা করা দরকার তাই করছি। কান নিয়েছে চিলের মত তাই অনেক লোকই মনে করে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়াটা নজরুলের বদান্যতায়। সোজা বাংলায় চুরি। অথচ বয়সের হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পান নজরুল তখন বালক মাত্র।

বেশির ভাগ লোকজন না পড়েই, না জেনেই সাহিত্য বা তার স্রষ্টাকে ঘৃণা করে। সাহিত্যকর্মের উদ্দেশ্য কখনই মারামারি লাগানো নয়। ভালোবাসতে কারন দরকার হয় না। ঘৃণা করতে দরকার।

বাংলাদেশ ২.০ লোড হবার পরে, আমি ইউটিউবে যে লোকটার বক্তৃতা সব থেকে বেশি শুনি তিনি হচ্ছেন, সলিমুল্লাহ খান। ইনি আবার আহমদ ছফার শিষ্য। চরম বাগ্মী এই লোক যখন কথা বলা শুরু করেন তখন আমি দুই প্লেট বিরিয়ানি এমনিতেই শেষ করে দিতে পারি। 

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তিনি যখন বলা শুরু করেন তখন এক রেললাইন থেকে গাড়ি অন্য রেললাইনে চালিয়ে দেন। On Track এ থাকতে পারেন না। বলা শুরু করেন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিন্তু মাঝখানে চলে গেলেন বাংলাদেশের ১০০ বছরের ইতিহাসে, রাজনীতিতে...। তবুও ভালো লাগে। 

তিনি মিথ্যা বলেন না। একারনেই তাকে শুনতে ভাল লাগে। তার দেয়া বর্ননাও অহীর মত আকাশ থেকে এসে পড়েনি। তিনি ফ্যাক্ট দিয়ে বলার চেষ্টা করেন। অনেকটা রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মত। প্রচন্ড পড়ুয়া লোক। এরকম আরেকজনের কথা আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি, তিনি হচ্ছেন ইয়োভাল নোয়া হারারি। শুধু তার লেখাই নয়, তার বলার ভঙ্গিও চমৎকার।

এনারা নমস্য, কারন এদের চিন্তাভাবনা আর সিদ্ধ্বান্ত ধর্ম থেকে আসে না, আসে নিজস্ব শিক্ষার দর্শন থেকে। এরা যখন কোন কিছু বললেন তখন ধর্মীয় বায়াসনেস থেকে সরে এসে বলার চেষ্টায় থাকেন। এই জিনিসটাই হচ্ছে সেক্যুলারিজম। নাস্তিকতা থেকে এর স্পষ্ট ব্যবধান আছে।

রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ না হয় তবে এই ধরনের বুদ্ধিজীবি গজায় না। রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নেই, কারন সে ব্যাক্তি নয়। ব্যক্তির ধর্ম থাকে। বাংলাদেশকে তার নিজস্ব পরিচয় থেকে মুছে দিতে চান, তবে শুধুমাত্র এর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিয়োজিত লোকগুলোকে ছাঁটাই করে ফেলুন। এরকমটা আগেও হয়েছে।

এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা তৈরি করেছি, যেখানে গন্ডায় গন্ডায় এ-প্লাস বের হয়ে আসে। এরা নিজেদের মেধাবী দাবী করে, কিন্তু চাকুরির আশায় হাঁ করে বসে থাকে। এই ব্যবস্থা চাকুরীর জন্য চাকর চায়, মেধাবী নয়।

আমাদের শিক্ষা আনন্দদায়ক নয়। 

 

 

মূর্খের গণতন্ত্র

দেশ নিয়ে লেখাটা খুব কঠিন। যাই লিখবেন না কেন, কিছু লোকের আঁতে ঘা লাগবেই। আমি সবসময়ই বলে এসেছি মূর্খের দেশে গণতন্ত্র থাকে না। যতই বিপ্লব হোক আর মানুষ মরুক বছর শেষে দেখা যাবে এদেশের মানুষ দশ বছর আগে যে মানসিকতার ছিলো এখনো তাই রয়ে গেছে।

গনতন্ত্রের সুফল পেতে হলে দেশের ৮০ ভাগ জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত হতে হবে। অতবা নূন্যতম নৈতিক মূল্যবোধ থাকতে হবে। এ দুটোই গড়ে ওঠে শিক্ষা ব্যবস্থা অথবা সাংস্কৃতিক বলয় থেকে। আমাদের না আছে ধর্মীয় শিক্ষা, না আছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অথবা নৈতিক দৃঢ়তা। মক্তবে যা বলা হয়, আর হুজুরে ওয়াজে যা বলে তাই বিশ্বাস করে বসে থাকে বেশিরভাগ লোক। রাজনৈতিক নেতায় মাইকে যেভাবে চিল্লায়, সহমত ভাইয়েরা সেভাবেই ঘাড় নাড়ে।

চিন্তা করে নিজে ভালো মন্দ বুঝে সিদ্ধান্ত নেবার লোক খুব কম। আমরা না মানুষ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের জন্য হয়ে গেছে ক্যানসারের মত। যত ধরনের গুজব আছে সব গুলোকে গুলিয়ে এখানে পরিবেশন করা হচ্ছে। গত পনের বছরে মানুষের মুখের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল এটা সত্য কথা, কিন্তু এখন যা হচ্ছে সেটাও আলাদা কিছু নয়। সবাই কে এক দলের হতে হবে এমন একটা দিব্যি নিয়ে নিয়েছে সবাই। তুমি কাউকে ঘৃণা করো মানে এই নয় যে আমাকেও সেই একই ব্যাক্তিকে ঘৃণা করতে হবে!

২০২৪ সালের শেষে এসে দেশ ইসলামিস্টদের দখলে না গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের দখলে। হেন জিনিস নেই এরা বিকৃত করছে না। ধর্মের উদারতা এদের শিক্ষায় নেই। খুব মোটা দাগে সোশ্যাল মিডিয়া বিবেচনায় - কেউ যদি হুট করে বলে দেয় বাংলাদেশ একটা মৌলবাদী রাষ্ট্র, আপনি তাকে ভূল প্রমান করতে পারবেন না।

আমাদের ধর্মান্ধরা বরাবরই বলে এসেছে এটা একটা মুসলিম রাষ্ট্র, অথচ সংবিধান বলে ভিন্ন কথা। এই রাষ্ট্র সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে। 

আঘাতটা সবসময় সবার আগে আসে সংস্কৃতির উপর। যাত্রা গান, পালা গান, পহেলা বৈশাখ, পথ নাটক, একুশের প্রভাত ফেরী, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, রবীন্দ্রনাথ সব কিছুতেই এই দলের প্রচুর আপত্তি। তারা পারলে এখনই শহীদ মিনার ভেঙে ফেলত, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করত।

পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবার পরেও, বিশাল ভূ-রাজনৈতিক দূরত্ব থাকার পরেও এই জনগোষ্ঠীর একাংশ পাকিস্তান প্রেমী।

ভারতকে অপছন্দ বা ঘৃণা করার একশটা কারন থাকতে পারে কিন্তু পাকিস্তানকে ভালোবাসার একটা কারনও আমি খুঁজে পাইনা।

শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে যে দেশগুলো ভাগ হয়েছে তারা নিয়তির লিখন খন্ডাতে পারবে না। এসকল জায়গায় ক্যাঁচাল সারাবছর লেগে থাকবেই।

নতুন সরকার এসে আপাত দৃষ্টিতে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারেনি। রাস্তার শৃঙ্খলা আগেও কম ছিল, এখন তা পুরোপুরি ভেঙে যাবার পথে। শহর জুড়ে অটো রিকশা চলছে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে। ক্ষেত্র বিশেষে এরা প্রাইভেট কারের ড্রাইভারকে গালিগালাজ করছে আস্তে চালানোর জন্য। আমি নিজে এর স্বাক্ষী।

ব্যবসায়ীরা আগেও দুই নাম্বারী করত এখনো তাই করে যাচ্ছে। যা কিছু ঘটছে এই দেশের সীমানায় তা এই জনপদ থেকে উঠে আসা বাঙ্গালীই করছে। তাই নীতিগত ভাবে বলাই যায়, বাঙালি একটা অসভ্য জাতি।

বাক স্বাধীনতা মানে, গলার জোরে আরেকজনের কন্ঠরোধ করা নয়, আগে চাঁদাবাজি করতে পারতাম না এখন অবাধে পারি সেটা নয়। ধর্মের নামে দেশের নাম পরিচয় মুছে দেবার চেষ্টা করা, সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা, কিংবা জাতীয় সংগীতকে মুছে ফেলার নাম বাক স্বাধীনতা নয়। 

রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকে না। রাষ্ট্র একটা ধারনা মাত্র। ধর্ম মানুষের খুব ব্যাক্তিগত একটা  বিষয়। আমরা সেটাকে খুব স্থূলভাবে কর্দমাক্ত করে ফেলছি। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে জলঘোলা করা যাবে, ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যাবে, মানুষ খুন করা যাবে- কিন্তু মানুষ হওয়া যাবে না।