আমি বাসা থেকে বের হবার খুব একটা সময় পাইনা। যতুটুকু পাই ততটুকুতেও আমি আসলে বের হতে চাই না। বাজারে গিয়ে কোন একটা জিনিস কিনে নিয়ে আসাটা আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। কাঁচাবাজারও এই জন্য আমি বেশিরভাগ সময় রাতে কিনি। জানি ঠকছি, তবুও কিনি।
প্রচুর প্রযুক্তি পন্য আমকে কিনতে হয়। আইটি প্রফেশনে থাকায় দরকারি যন্ত্রাংশ কিনতে আমি সাধারণত মাসে একবার এলিফ্যান্ট রোডে যাই। আগে এক বন্ধু সেখানে ব্যবসা করত, তার সাহায্যে সময় বাঁচিয়ে খুব অল্পদামে আমি প্রোডাক্ট কিনতে পারতাম। এখন আর সে নেই।
আমার ভরসার যায়গা এখন অনলাইন থেকে কেনাকাটা করা। যদিও কিছুটা অনাস্থা থেকে যায়, তারপরও চেষ্টা করি বাজারে না গিয়ে বাসায় বসেই যদি সেই কাজটা সেরে ফেলা যায়, তবে দুটো টাকা বেশি গেলেও ক্ষতি নেই।
দারাজ থেকে আমি অনেক অর্ডার করি। চায়নিজ প্রোডাক্টও এরা খুব তাড়াতাড়ি এনে দিতে পারে। কিছুদিন আগে অর্ডার করা একটা এক্সটেনশন কেবল, যেটা আমি মার্কেটে গিয়ে খুঁজেও পাইনি দারাজে অর্ডার দিইয়েছিলাম।
ডেলিভারি ম্যান সাধারণত আমাকে নিচে এসে ফোন দেয়, আমি গিয়ে নিয়ে আসি। আজকে অদ্ভুত বিষয় হল, দারাজের একজন ডেলিভারি ম্যান ফোন দিয়ে আমাকে বলল, "আমার শরীর খারাপ লাগছে আমি চলে এসেছি হাবে। আপনার প্রোডাক্টটি আমি ডেলিভারড দেখিয়ে দিলাম। কালকে জুমার নামাযের আগে আমি আপনাকে দিয়ে যাবো।"
আমি ছোট্ট করে বললাম, ঠিক আছে।
আমার সমস্যা নেই, এটা অত জরুরী কিছু না। কাল নিলেও হবে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল, ডেলিভারি কালকেই করুক, কিন্তু ডেলিভারড দেখাতে হবে কেন?
কেবলের দাম বেশি না। সে যদি এটা গায়েব করেও দেয় তবে আমার বিশেষ কোন ক্ষতি হবেনা। তবে আমার মানসিক ক্ষতি হচ্ছে, আমি একে অবিশ্বাস করছি। সে হয়ত আজকে ক্লান্ত তাই দিতে পারছে না, আগামীকাল দেবে। আর রাত ৮ টা বেজে গেছে, সবারই এখন বাসায় ফেরার তাড়া।
কিন্তু আমি এদের অবিশ্বাস করা শুরু করেছি। এমন না যে, আমার কোন প্রোডাক্ট আমি ডেলিভারি পাইনি, বা এর আগেও তারা না দিয়েই বলেছে, দিয়েছি...। তবুও হঠাত করে এই শ'পাঁচেক টাকার প্রোডাক্টের জন্য আমি একজন মানুষকে সময়ের আগেই অবিশ্বাস করছি।
নৈতিকভাবে কি দৃঢ়তা হারাচ্ছি?
আমি মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকতে রাজি আছি, প্রথমবার। দ্বিতীয়বার বোকা সাজতে রাজি না। কিন্তু এই যে অস্থিরতা গত কয়েকদিন আমার মাঝখানে চলে এসেছে সেটা উপভোগ করতে পারছি না।
প্যানিক এটাকে আবার আক্রান্ত হতে যাচ্ছি মনে হয়।
আমি জীবনে অনেকবার ঠকেছি, শিখেছি, কিন্তু কখনো মনোবল হারাইনি। আমাকে যারা ঠকিয়েছে তারা সবাই আমার পরিচিত। অপিরিচিত মানুষের কাছে ঠকেছি খুব কম। হতাশার বিষয় হল মানুষ ঠকানোর শিক্ষা পরিচিতজনের কাছ থেকে নিতে হয়েছে আমাকে।
আমার সমস্যা বা অভাবের কথা আমি কাউকে বলি না। তাতে আমার পরিচিত জনদের ধারনা এই মানুষটা বোধহয় একটা সমস্যাবিহীন জীবনযাপন করে। নারে ভাই, রক্ত মাংসের মানুষ আমি। আপনাদের মত আমাকেও সংসারের বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হয়, কি তরকারি রান্না হবে সেই চিন্তা করতে হয়। বাচ্চার স্কুল, টিফিন নিয়ে চিন্তা করতে হয়। আমার বিশেষত্ব হচ্ছে, আপনি এগুলো নিয়ে গসিপ করেন, আমি করি না।
আমি নিভৃতে চিন্তা করতে ভালোবাসি।খুব কাছের দু-তিনজন বন্ধুবাদে আমি কারো সাথে সময় নষ্ট করে আড্ডাও দিতে চাই না।
সেদিন অনেক আগের এক বন্ধু, যে লেখালেখি করে, সে আমাকে বলল দেশে এলে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি অপারগতা জানালাম। কারো সাথে বসে আড্ডা দিতে এখন আর ইচ্ছে করে না। অনেক দূর থেকে কেউ একজন এসে অনিচ্ছুক একটা চেহারা দেখুক, সেটাও চাই না।
দিনদিন ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছি। আমার শুধু দরকার এক রুম ভর্তি বই, একটা কম্পিউটার আর কফি।