সালতামামি ২০২৪
সূর্যের চারিদিকে একবার নিজের কক্ষপথ ভ্রমন করে আসলে এই গ্রহের মানুষেরা নববর্ষ উৎযাপন করে। ২০২৪ সাল চলে গিয়েছে, ২০২৫ এর দ্বিতীয় দিন আজ।
আমি গতবছরে এই সময়ে ছিলাম ভারতে। সেখানে ঢাকার আতশবাজি উৎসব দেখতে পারিনি। এবার দেখেছি, কিছুটা ভাল লেগেছে পরিচিত উন্মাদনা দেখে। মধ্যরাতের দশ মিনিট আগে শুরু হওয়া এই পটকাবাজি দেখে আপনি নিশ্চিত হয়ে যাবেন দেশের মানুষ এখনও খেতে পরতে পারছে। অহেতুক আনন্দ উল্লাস করছে।
আনন্দ সবসময়ই অর্থহীন। আমি একে কখনও খারাপ-ভালো কোন চোখে দেখি না। মানুষ যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী উৎসবে যোগ দেবে।
২০২৪ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ঘটনাবহুল একটা সময়। সরকার পতন এবং রাজনীতির গোলমেলে সময়ে, মানুষের ভাগ্য না বদলালেও, আমরা বদলে গেছি অনেক। একটা সত্য যে নানারকম ভাবে প্রকাশ করা যায়, এর যে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা থাকতে পারে, তা এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস না পড়লে বুঝতে পারবেন না।
আমাদের গণতন্ত্র নাই, অথচ বুক ফুলিয়ে সব রাজনৈতিক দল এককভাবে এর দাবি করে। সবাই একই দাবি করে অথচ কেউ গণতন্ত্রের পথে হাঁটে না।
আমার নিজের জন্য এ বছরটা খুব একটা ভালো যায়নি। অর্থনৈতিক এবং পারিবারিক সবদিকেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। স্ত্রীর অসুস্থতা আর নিজের কাজে ফিরতে না পারা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানসিকভাবেও অনেকদূর পিছিয়ে গেছি। নতুন কোন গল্প লেখা হয়নি। কবিতারা মাঝে মধ্যে উঁকি দেয়।
দেশের ব্যপারে আমি যে খুব বেশি মাথা ঘামাই তাও নয়। ছাগলের তিন নম্বরের বাচ্চা হবার থেকে চুপচাপ সব দেখে যাওয়াটাই উত্তম। তবে ২০২৪ সালে আমি শিখেছি - রাজনীতিবিদেরা আসলে জনগনের থেকে বেশি বোঝেন না। তারা যেটা বোঝেন সেটা আবার সাধারণ জনগন বোঝে না এবং মানেও না।
Politics is more about influence, than ideal - আদর্শের থেকে প্রভাব বিস্তার করাটাই রাজনীতিতে মূখ্য। সাধারণ জনগন এই জিনিসটাই বোঝে না। তারা নিজেরা চোর হলেও একজন আদর্শবান নেতা চায়। তিনি হবেন ফেরেস্তার মত। মাঝে মধ্যে দুষ্টামির জন্য একটু আধটু শাস্তি দেবেন মাত্র।
এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মনে প্রানে সাম্প্রদায়িক। এরা ভোটের সময় চায় গনতান্ত্রিক পদ্ধতি আর শাসন ব্যবস্থা চায় খিলাফতের মত করে।
ছাগলের কাছে কোয়ান্টাম ফিজিক্স ব্যাখ্যা করার মত করে দেশের টকশো ব্যবসায়ী চ্যানেল আর দেশীয় বুদ্ধিজীবিরা প্রতিনিয়ত বকে যাচ্ছেন। পত্রিকায় আর কেউ নিউজ পড়ে না। বাঙালি আসলে পড়াশোনাটাই কম করে। এখন ইউটিউব আর ফেইসবুকে রাজনৈতিক বিশ্লেষন চলে। সেখান থেকেই আমরা বেছে নেই, কে ভালো আর কে খারাপ।
শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সবথেকে বড় রাজনৈতিক নেতা থাকলেও আওয়ামীলীগের বর্তমান ব্যর্থতার কারনে ডি-ফেইমের শিকার হচ্ছেন। এমনকি তার ৭ই মার্চের ভাষনকেও এখন অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলে মানতে নারাজ।
জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং শেখ মুজিবের হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘোষনা পাঠকারী হলেও পরবর্তীতে গণতন্ত্রের পথে হাঁটেননি।
আমাদের বিগত প্রধানমন্ত্রী যিনি পিতার কথা বলে সবসময় কেঁদে বুক ভাসাতেন, তিনিও একসময় ভোটে কারচুপি করলেন। হয়ে গেলেন স্বৈরাচারী।
স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার আগেই যারা যুদ্ধ শুরু করেছিল ২৫ তারিখেই তারা হচ্ছে পুলিশ। পুলিশ পাক-আর্মির কাছে আত্মসমর্পন না করে বিদ্রোহী হয়ে যুদ্ধ করাটাকেই শ্রেয় মনে করেছিল। অথচ এরাও একসময় দেশের জনসাধারনের উপর গুলি চালিয়েছে।
মাঝেমধ্যে বর্তমান অতীতকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে।
এই জনপদে যেই নেতা হচ্ছে সেই পথভ্রষ্ট হচ্ছে। ক্ষমতার ধর্মই হচ্ছে তা নষ্ট হবে। এই কারনেই শাসনব্যবস্থা আর সংবিধানের এমন হওয়া দরকার যাতে কেউই খুব বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে না পারে।
২০২৪ বাংলাদেশের জন্য একটা দুঃসময়।
২০২৪ এ অনেক কিছু শিখেছি।
শিখেছি, টাকা মানুষের সবথেকে বড় বন্ধু। টাকা দিয়ে তুমি এমন সব আনন্দ কিনতে পারবে যেটা সাধারনের দৃষ্টিতে অধরা অথবা হারাম। জগতের বেশিরভাগ সুখ আসলে পাপে।
- টাকা থাকলে তুমি তোমার সমস্যা সমাধান করতে না পারলেও আশেপাশের মানুষের সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
- অতিরিক্ত অর্থ বলে কিছু নেই।
- ফাঁকা কলসি বাজে বেশি এবং গনতান্ত্রিক চোরেরা সবার থেকে বড় সাধু।
- এদেশের মেধাবীরা পড়াশোনার থেকে ক্ষমতা পাওয়াটাকে বেশি বড় করে দেখে। এজন্য দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক হবার থেকে তারা বিসিএস ক্যাডার অথবা রাজনৈতিক নেতা হওয়াটাকে প্রাধান্য দেয় বেশি। বিগত পঞ্চাশ বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেটাই শিখিয়েছে এদের।
- ধর্ম শুধুমাত্র একটা নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা। এর এপিঠ ওপিঠ বলে কিছু নেই। তুলনা শুধুমাত্র দুইটা ধর্মের মাঝে হতে পারে। ধর্ম আর বিজ্ঞানের মাঝে তুলনা করে অর্বাচীন।
- পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের কোন বিকল্প নেই।
- যে কোন ধরনেই জাতীয়তাবাদি চেতনাই সমাজ, দেশ এবং পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর।
- দান করলে তুমি বড়লোক হবে, এইটা একটা মিথ্যা প্রচারনা।
২০২৪ সালে সব থেকে কঠিনভাবে উপলব্ধি করেছি, সুখে থাকতে গেলে তোমাকে স্বার্থপর হতে হবে। যে নিজে সুখি না, সে কোনভাবেই আরেকজনকে সুখে থাকতে দেবে না। এ ধরনের মানুষ অতি প্রিয়জন হলেও তাকে ত্যাগ করতে হয়।