পোস্টগুলি

ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

লেজকাটা শেয়াল এবং মনস্তত্ত্বের খেলা

শেয়ালের গল্পটা মনে আছে? সেই যে তার লেজ কাটা বলে সে অন্যদেরও ফুসলিয়ে নিয়ে যায় লেজ কাটার জন্য। তার আগে সে বর্ননা করে লেজ কাটা থাকার মাহাত্ব্য কত প্রকার এবং কি কি?

বাংলাদেশীদের চরিত্র অনেকটা এই শেয়ালের মত। সে কোন কাজে যদি অসফল হয় তাহলে সে চায় তার সবচেয়ে কাছের ব্যাক্তিরাও অসফল হোক। তাতে তার নাক বাঁচে। বন্ধুদের মাঝে কেউ ভালো কিছু করলে বা চাকুরিতে প্রমোশন পেলে তাই তার হিংসা হয়। নিজে ফেল করলে সমস্যা নাই, কিন্তু বন্ধু পাশ করে গেলে অনেক বেশি দুঃখ হয়।

মনে মনে তারা ভাবে - যদি আমি ভুল করি তবে অন্যরা বাদ যাবে কেন? কেউ ভালো কিছু করতে গেলে পেছন থেকে টেনে নামানোও এই একই মনস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের নিন্দা করে, সমালোচনা নয়। সমালোচনা করতে গেলে সেখানে খারাপ এবং ভালো দুটো নিয়েই আলোচনা করতে হয়। কিন্তু আমি যতদিন দেখেছি এরা যখনই হাতে মাইক পায় শুরু হয় বদনাম করা। নিজেদের স্তুতির সাথে সাথে প্রতিপক্ষকে যেনতেন ভাবে সবার সামনে উলঙ্গ করাই এদের প্রধান কাজ।

স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে একটা সেক্যুলার সিস্টেম। সেখানে সব কিছু পড়ানো হবে, কোন ধর্মের বইয়ের সাথে মিললো সেটা দেখার বিষয় নয়। অথচ এই সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিক্টেট করতে চায় লেজকাটা শেয়ালেরা। বাচ্চারা কি পড়বে না পড়বে সেটা ধার্মিকেরা কেন তৈরি করবে? ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা আছে, মক্তব আছে, হেফজখানা আছে। যার দরকার ইসলামিক লাইনে পড়াশোনা করার সে সেখানে গিয়ে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহন করবে। এমনিতেই দেশের পাঠ্যবইয়ে ভুল এবং আদিম তথ্যে ভরা। তার উপর যদি মোল্লাতন্ত্রের খড়গ চলে এবং ধর্ম ঠিক করে দেয় কি পড়ানো যাবে আর কি পড়ানো যাবে না, তবে আমাদের বর্তমান অন্ধকার আরো ঘন হবে।

কে কি পড়বে না পড়বে সেটা এই যুগে এসে ঠিক করে দেয়াটাই এক ধরনের মূর্খতা। পৃথিবীর জ্ঞান হতে হবে উন্মুক্ত। তুমি মুর্খ বলেই আরেকজনকেও কেন মূর্খ বানাতে হবে?

লেজকাটা শেয়ালেরা জীবন উপভোগ করে না। তারা মনে করে পৃথিবীতে আনন্দ করা নিষিদ্ধ এবং জ্ঞান অর্জন করা পাপ। শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার প্রচলন করেই এই জনপদে সকল ধরনের শান্তি এবং উন্নতি আনা যাবে। এরা এখন দলবদ্ধ হয়ে মাইকে রাজনৈতিক নেতাদের মত হুংকার দিচ্ছে। মেয়েদের ফুটবল খেলায় বাধা দিচ্ছে, কনসার্ট-নাটকে হামলা চালাচ্ছে, হোটেলে গিয়ে নিজেরাই অভিযান চালাচ্ছে কেন সেখানে গরুর মাংস বিক্রি করা হয় না এই অপরাধে! একটা সাধারণ মানের খাবার হোটেল কি বিক্রি করবে আর কি করবে না, সেটা এরা ঠিক করে দিচ্ছে। এরা যখন স্বৈরতন্ত্রর অধীনে থাকে, তখন বাক স্বাধীনতার কথা বলে, সমানাধিকারের কথা বলে, কিন্তু গোয়াল থেকে ছাড়া পেলেই বাকি সবার স্বাধীনতা হরনে নেমে যায়।

শুধুমাত্র গরু জবাই করে পিকনিক করাকে এরা স্বাধীনতা উপভোগ করার মাধ্যম হিসবে বেছে নিয়েছে। কি অদ্ভুত! বাঙ্গালী প্রতিবছর লাখে লাখে গরু জবাই করে খায়। কেউ এটাকে বিশেষ কিছু মনে করে না। কিন্তু শেয়ালেরা ভাবে বিশ কোটির সবাই মনে হয় তাদের মতই চিন্তা ভাবনা করে। তাই জায়গায় বেজায়গায় তারা এখন এই গরু জবাই করে খাওয়া-দাওয়া করছে। দেশের বিশেষ কোন উপকার না হলেও এরা এটাকে বিজয়ের আনন্দ হিসেবে উদযাপন করছে।

এই গোষ্ঠীকে আপনি মব বলেন আর তৌহিদি জনতাই বলেন, এরা আদতে দীর্ঘমেয়াদে দেশের অকালকুষ্মাণ্ড রাজনৈতিক শেয়ালদের স্বেচ্ছাচারিতারই ফল। রাজনৈতিক শেয়ালেরা কখনই চায়নি দেশের জনগন শিক্ষিত হোক। শিক্ষিত হলে তাদের ভোটবাক্সে টান পড়বে। শোষন করার মত ভেড়ার পাল পাওয়া যাবে না। এরা একটা ভেড়ার পাল তৈরি করেছে।

ভোটের জন্য মাথা দরকার, বুদ্ধিমান দরকার নাই। কেউ ধর্ম বেচেছে, কেউ আবেগ আর চেতনা - সব একই রকম শেয়াল। নিজেদের লেজ কাটা বলে অন্যদেরও এরা তাই করেছে। একটা অপদার্থ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা দেশের সম্পদ নয়, বরঞ্চ বোঝা।

নারীরা সমাজের একটা বিশাল অংশ। যে কোন ভাবেই হোক তাদের ঘরের মাঝে বন্দী রাখতে পারলেই এই শেয়ালদের লাভ। তাই পর্দার নামে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলাটাকে এরা আবশ্যকীয়তার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরপর এই ব্রেইন ডেডদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে জনতার মাঝে। তাই কখনো এরা আন্দোলন করে বিনা ফটোর এনআইডি কার্ডের জন্য, অথবা প্রচারনা চালায় বহুবিবাহের সুফল নিয়ে। এই সব শেয়ালদের শিকার মূলত নতুন প্রজন্মের নারীরা।

বহুবিবাহে পুরুষের লাভ আছে। সে অনেক সম্ভোগের সাথী পায়। কিন্তু নারীদের কিছু পাবার নেই সেখান থেকে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে কোন কাজে অংশগ্রহন করতে গেলে আপনার ফটো আইডি লাগবে। সেটা এনআইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা পাসপোর্ট সব ক্ষেত্রেই একই নিয়ম। সেখানে ছবি বাদে আইডি বানানোর দাবি করা মানে এই সকল কর্মকান্ডে এই নারীরা আর অংশগ্রহন করতে পারবে না। সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতেও সমস্যা হবে এই নারীদের। কারন রাষ্ট্র তাদের ছবি বাদে আইডি দেবে না। এরা অবাঞ্ছিতই থাকবে।

 

স্থায়ী ঠিকানা

একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কতবার বাসস্থান পরিবর্তন করে?

এই তথ্য আমাদের দেশে সংগ্রহ করা হয় না। আমি একটা অনুমান নির্ভর কথা বলতে পারি, প্রতি পাঁচ বা ছয় বছর পর পর মানুষ তার বাসা পরিবর্তন করে। বাসা পরিবর্তনের সাথে ব্যাক্তির পেশা বেশি জড়িত। গ্রামাঞ্চলের লোকজন যারা কৃষিকাজের সাথে জড়িত তারা সাধারনত বাসা পরিবর্তন করে না। নিজের কেনা সম্পত্তিতে বা বাসায় যারা থাকেন তারাও সহজে বাসস্থান পরিবর্তন করেন না।

বাসসস্থান পরিবর্তনের মূল কারন শিক্ষা এবং চাকরি। দেখা গেছে ছেলেকে পড়াশোনা করানোর জন্য বাবা তার বসত ভিটা ছেড়ে শহরে এসে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। নতুন চাকুরি পাওয়ার পর বা চাকুরিতে বদলি হলে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় সরে যেতে হচ্ছে লোকজনকে। 

বাসা ভাড়াও বাসস্থান পরিবর্তনের কারনগুলোর একটা। শহরের পশ (posh) এলাকাগুলোতে বাসা ভাড়া বেশি। সেখানে রিকশাভাড়া, বাজারের খরচ এবং আনুষঙ্গিক খরচও বেশি হয়। মধ্যবিত্তরা সাধারণত সে এলাকায় বাসা ভাড়া নিতে পারেন না। সে সকল এলাকায় যারা থাকেন তাদের লাইফস্টাইল সম্পূর্ন আলাদা। যেমন আমাদের পুরান ঢাকা আর গুলশান এলাকায় বাসা ভাড়ার আকাশ পাতাল তফাত। দুই এলাকার সংস্কৃতিতেও পার্থ্যক্য আছে। পুরান ঢাকায় বা গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা কফিশপে বসে আড্ডা দেয়না, ছেলে বন্ধুর সাথে বসে স্মোক করে না, ধর্ম মেনে চলা বা না চলাটা তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। পোষাকের কারনে তাকে অযথা হেনস্থা হতে হয় না ইত্যাদি। একই শহর অথচ দুটো জায়গায় আপনি আলাদা রকমের স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবেন।

যারা সাধারনত একবার নিজের বাসা ছেড়ে চাকরি, ব্যবসা বা শিক্ষার কারনে অন্য জায়গায় থাকতে বাধ্য হন, তাদের দুইটা ঠিকানা থাকে। একটাকে তারা স্থায়ী আবাস, আরেকটাকে বর্তমান ঠিকানা বলেন। স্থায়ী আবাস বলতে মানুষ মূলত যেখানে জন্মগ্রহন করেছে বা বাপ-দাদারা থাকতেন সেই ঠিকানাটাকে বোঝাতে চান। যদিও আমি এই দুই ঠিকানার ঘোরতর বিরোধী।

বছরের তিনশত পয়ষট্টি দিনের তিনশ দিনই যদি চাকরি বা অন্য কারনে আপনাকে একটা নির্দিষ্ট স্থানে থাকতে হয় তবে সেটাই আপনার স্থায়ী আবাস। আপনার বাপ-দাদার ভিটাতে আপনি কদাচিৎ যান, সেখানে থাকেন না। আবার যখন যান তখন নিজেকে আর সেখানকার সংস্কৃতির সাথে মেলাতেও পারেন না। অতিথির মত যান আর কয়েকটা দিন থেকে ফেরত আসেন। সেটাকে শুধু এনআইডি আর পাসপোর্টে জন্মস্থান হিসেবে ব্যবহার করেন, এই জায়গা কোনভাবেই আপনার স্থায়ী ঠিকানা হতে পারেনা।

মানুষের আসলে স্থায়ী কোন ঠিকানা হয় না। আমি নিজেই আমার প্রতিটা পাসপোর্টে আমার স্থায়ী ঠিকানা একবার করে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। বেঁচে থাকতে যে আবার করবনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

খুব কম মানুষই আছেন যারা খুব পরিকল্পনা করে নিজের বাসস্থান বেছে নেন। বেশিরভাগ সময়েই তার চাকুরি বা ব্যবসাবৃত্তি তাকে বাধ্য করে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করতে। অনেকে আবার আবেগের কাছে হেরে যান এবং নিজের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত এলাকার মায়ার টানে পড়ে একই এলাকায় পড়ে থাকেন বছরের পর বছর।

বয়স ত্রিশ হবার আগেই আপনাকে যে সিদ্বান্তগুলো নিয়ে ফেলতে হবে তার একটা হচ্ছে "আপনি কোথায় থাকতে চান।" সেখানে ভাড়া বসায় থাকুন বা নিজের ফ্ল্যাটে, অথবা জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে, যাই করেন না কেন - আগে থেকেই ভেবেচিন্তে ফেলুন। কারন বাসস্থানের উপর নির্ভর করে আপনার তিনটা প্রধান চাহিদা পূরণ হবে, আপনার আয়, সন্তানের শিক্ষা এবং দরকারি স্বাস্থ্য সেবা।

এমন একটা এলাকায় থাকুন যেখান থেকে এই তিন সেবা এবং কর্মকান্ড আপনি সহজে পরিচালনা করতে পারেন। স্থায়ী ঠিকানার মোহে পড়ে থাকবেন না। যেখানে বছরে মাত্র অল্প কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাবেন সেটা কাগজে কলমে আপনার স্থায়ী ঠিকানা হলেও, নিজের মনে সেটাকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বিশ্বাস করা বাদ দিন। 

আমি এমনকি উপদেশ দেই, যেখানে আপনি সারাবছর থাকেন না সে এলাকার কর্মকান্ডে কোন ধরনের ইনভেস্টমেন্টে না যেতে। যদি গ্রামে না থাকেন সারাবছর, সেখানে জমি কেনা বন্ধ করুন, সেখানে একতলা টিনের ঘরকে পাকা বানানো বন্ধ করুন। এই অর্থ ব্যবসা বা অন্যকোন জায়গায় খাটান।

এমন অনেকের সাথে কথা বলেছি, যারা ব্যবসা করেন শহরে, পরিবার নিয়ে এসেছেন এখানে থাকার জন্য, বাচ্চারা শহরের স্কুলে পড়ে, এখানকার সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে, কিন্তু গ্রামে তাদের অব্যবহৃত বাড়ি পড়ে আছে। অনেক জায়গা জমি আছে এবং বছর বছর সেই ব্যাক্তিরা বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা আর ঝগড়ায় জড়াচ্ছেন এই সকল সম্পত্তি নিয়ে। আয়ের থেকে ব্যয় আর সময় নষ্ট বেশি হচ্ছে এই সম্পত্তি সামাল দিতে গিয়ে।

এগুলো আসলে আপনার সম্পত্তি নয়, লায়াবিলিটি। যে ইনভেস্টমেন্ট বা প্রপার্টি আপনাকে আয় দেবে না সেটাই আপনার লায়াবিলিটি। বুদ্ধিমানেরা লায়াবিলিটি বাড়ায় না, মায়ায় পড়েও না। যে বিজনেস লাভের মুখ দেখছে না সেটা বন্ধ করে দেয়াটাই উত্তম। আবেগে পড়ে হাতি পোষার কোন মানে হয় না। 

এই দেশে অবশ্য একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, স্থায়ী বাসস্থানের ঠিকানা বলে একটা অবান্তর জিনিস কাগজপত্রে উল্লেখ করতে হয়। এই নিয়মের পরিবর্তন করা দরকার। একজন ব্যাক্তির স্থায়ী ঠিকানা হবে তার দেশ। বৃহৎ পরিসরে আমি অবশ্য মানুষের তৈরি বর্ডার আর জাতীয়বাদী চিন্তারও বিরোধিতা করি।


 

বাংলাদেশ ২০২৪ - ২০২৫

খাবার খাওয়ার সময় আগে আমি মুভি দেখতাম। অনেক দিনের অভ্যাস। একটা মুভির চারভাগের একভাগ দেখে ফেলতাম দুপুর বা রাতের খাবার খেতে খেতে।

এখন আমি ইউটিউবে বাসি টকশো দেখি। যেহেতু পত্রিকা পড়ি না, টিভি দেখি না, তাই এই টকশো গুলোই হচ্ছে আমার দেশের পরিস্থিতি মাপার প্রধান উপায়। বিনোদনের সাথে সাথে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের এবং নিজের রাজনৈতিক জ্ঞান ঝালাই করা হয়ে যায় এই সময়ে।

মোটাদাগে, টকশো দেখে আর ফেইসবুক থেকে আমি বুঝতে পারছি "বর্তমান বাংলাদেশ" একটা অস্থিতিশীল দেশ। জনগন প্রচন্ড রকমভাবে রাজনীতি সচেতন হলেও তারা আদতে রাজনীতিতে অজ্ঞ। এখানে ইউটিউব আর ফেইসবুক সেলিব্রিটিদের একটা চরম প্রভাব আছে জনমত তৈরিতে। দেশের বাইরে বসে কিছু লোকজন অনবরত দেশ নিয়ে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে আর আমজনতা সেই ফাঁদে পা দিয়ে গন্ডগোল পাকাচ্ছে।

যে সুদিনের আশায় বিপ্লব হয়ে গেলো দেশে, একটা দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচনহীন সরকার সরে যেতে বাধ্য হল, সেই সুদিন আদতে আসেনি। যারা বিপ্লব করেছিল তারা নিজেরাই এখন স্বৈরশাসকের অসম্পূর্ন ভুমিকায় অভিনয় করতে চাইছে।

সবাই সংস্কার চাইছে, অন্তত সংস্কারের কথা বলছে। কিন্তু কারো মাথায় এটাই ঢোকে না- যে দেশে পনের বছর ধরে কোন সুষ্ঠ নির্বাচন হয় না, সেখানে সব দলের অংশগ্রহনে নির্বাচন হয়ে যাওয়াটাই একটা বড় ধরনের সংস্কার। আবার নির্বাচিত সরকার না হলে অনেক সংস্কারই মূল্যহীন হয়ে যাবে।

আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার কথা শুনছি কদিন থেকে। ব্যাপরটা বেশ হাস্যকর লেগেছে আমার কাছে। স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধীতা করা দল জামায়েতে ইসলাম যদি তিপান্ন বছর পরেও এদেশে রাজনীতি করে, তবে আওয়ামীলীগ এদেশে আরও অনেকদিন রাজনীতি করে যাবে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে এদেশে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ এখনো শীর্ষে। শুধুমাত্র গলার জোরে চিৎকার করে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনেছি বললেই সমন্বয়কেরা দেশের মালিক বনে যায় না। তাদের অহেতুক আস্ফালন তাই একসময় স্তিমিত হয়ে যেতে বাধ্য।

আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতার সাথে সরাসরি জড়িত দল, সে হিসেবেও ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে। এই বিপ্লবকে যুদ্ধ বলে চালানো গেলে হয়ত জামায়েতের মত আওয়ামী লীগকেও যুদ্ধাপরাধী বলে চালানো যাবে। এই আইডিয়াটা অবশ্য মন্দ না। কিছুদিন ধরেই স্বাধীনতার অনেক পরে জন্ম নেয়া শিবিরের ছেলেদের টকশোতে এসে বলতে শুনেছি ৭১ এর স্বাধীনতা আসলে ভুলে হয়েছে, ওটা ভারতের ষড়যন্ত্র ছিল। তারা এই স্বাধীনতা চায়নি। 

যেহেতু ভারত সাহায্য করেছে তাই তারা এমনটা চায়নি বলে আসলে ৭১ এ জামায়েত ইসলামের ভূমিকাকে জায়েজ বানানোর একটা চেষ্টা করা হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, এরা যখন জন্মগ্রহন করেনি তখনকার যুদ্ধটা এদের চাওয়া না চাওয়াতে কি বদলানো যাবে? বৈজ্ঞানিক ভাবে তো না। গায়েবি উপায় আমার জানা নেই। 

রাতারাতি উপদেষ্টা বনে যাওয়া একজন, যে অনেক বছর ছাত্রলীগের ডানার নিচে লুকিয়ে ছিল, সে তার বালক সুলভ চপলতায় বঙ্গবন্ধু কে জাতির জনক মানতে নারাজ। ব্যক্তিগতভাবে সে চাইলেই তা না মানতে পারে। এটা তার চিন্তার আর বাক-স্বাধীনতার বিষয়। কিন্তু শেখ মুজিব যখন বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এবং যখন তাকে জাতির জনক উপাধি দেয়া হয় তখন এদের অনেকের জন্মই হয়নি। 

এই ধরনের স্টেইটমেন্ট তাদের চিন্তার অপরিপক্কতা প্রকাশ করে।

পিনাকি নামে একজন ইউটিউবার এর প্ররোচনায় এরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙচুর করে গুড়িয়ে দেয়। এই পিনাকি একটা ইতর বিশেষ। খুব অদ্ভুত ভাবে হিন্দু ধর্মালম্বি হয়েও সে এদেশের মোল্লাদের ত্রাতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। কি সেলুকাস! 

এই লোকটা ঔষধ কেলেংকারির সাথে জড়িত ছিল একসময়। প্রাক্তন শাহবাগী হিসেবেও তার সুনাম আছে। বাংলাদেশের মুমিন বান্দারা যেভাবে তাকে পীর হিসেবে মেনে নিয়েছে সেটা প্রমান করে এদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা আর চিন্তার অসুস্থতা চিরকালীন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আরো অনেক স্থাপনা ভাঙ্গা হয়েছে। এতে লাভ হয়েছে আওয়ামী লীগের। তাদের ভাষ্য সত্য বলে প্রমানিত হচ্ছে।

সাংবাদিক মাসুদ কামালের কথা আমি শুনি, এ লোকটা ফ্যাক্ট দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। কার পক্ষে গেল তার ধার ধারেন না। তার ভাষা খুব মার্জিত। পিনাকির মত অশ্লীল না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তিনি যথেষ্ট পরিপক্ক।

আওয়ামী লীগ যখন ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে তখন যে তারা খুব আহামরি ভালো কিছু করে জিতে যায় এমনটা নয়। তারা ক্ষমতায় আসে বাকি দলগুলোর মূর্খের মত কাজকর্মে। এবার তৌহিদি জনতার উত্থান দেখে, দেশের মোল্লারা যে আদতে মৌলবাদি চিন্তা-ভাবনায় আচ্ছন্ন এবং আওয়ামী লীগ না থাকলে দেশটা জঙ্গিবাদে ভরে যাবে  - এ ধরনের একটা ন্যারেটিভ ইতিমধ্যে দাঁড়া হয়ে গেছে সাধারনের মনে। "আগেই ভালো ছিলাম" - এই মনোভাবের লোকের সংখ্যা তাই দিনদিন বাড়ছে।

আরব বসন্তের পর পর সে দেশগুলোতে মৌলবাদের একটা উত্থান ঘটেছে। তারা কেউ ভালো নেই। বাংলাদেশ সেই পথেই হাঁটছে। এখানে বাক-স্বাধীনতার কথা বললেও সবাই অন্তরে একেকজন স্বৈরাচার।

আমাদের সমস্যা শিক্ষায়। ওয়াজ মাহফিল যাদের ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের উৎস, তাদের দিয়ে যেকোন দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলানো সম্ভব।

ক্ষমতার শীর্ষে যারা থাকেন তারা সাধারনত একাকি হয়ে যান। আশেপাশে মোসাহেব ভরা থাকে। দেশের বাস্তব চিত্র বুঝতে পারেন না। আর হঠাৎ করে কেউ ক্ষমতা পেয়ে গেল সে সাধারনত স্বৈরাচারী হয়ে যায়। ইউনুস সরকার সেই পর্যায়ে আছে। এখান থেকে কিছুটা মান-সম্মান নিয়ে বেইল আউট করতে গেলে প্রফেসর ইউনুসের উচিৎ নির্বাচন দ্রুত দিয়ে গাধাদের শাসনভার তাদের নেতার হাতেই ছেড়ে দেয়া।


বিশ্ব সাহিত্য ভাষন -১ ( মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি)

 
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ এর লেখা প্রথম বই পড়েছি "আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র", এবং তখনই তার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক আর প্রাঞ্জল লেখার প্রমান পাই। পাঠককে খুশি করার বদলে তাদের মস্তিষ্ককে ধাক্কা দেয়ার প্রবনতা তার মধ্যে আছে। আমি তাকে একজন যৌক্তিক লেখক হিসেবে পেয়েছি। এজন্যই তার লেখা অবশ্য পাঠ্য। আমার ক্ষমতা থাকলে হয়ত তার কিছু লেখা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে বলতাম।

এবার বইমেলায় যাবো কিনা সিদ্বান্ত নেইনি। প্রকাশনীগুলো অবশ্য এখন বাসাতেই বই ডেলিভারি করে। তাই বই হাতে পেতে কোন সমস্যা নেই।
 
ফেইসবুক মারফত জানতে পারলাম জালালুদ্দিন রুমিকে নিয়ে তার লেখা একটা বই এসেছে। রুমিকে নিয়ে কমবেশি ফ্যাসিনেশন আমার আছে। অথচ রুমির কাজের যতগুলো বাংলা অনুবাদ আমি পড়েছি সব মোটামুটি অখাদ্য।
 
কিন্তু মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আমাকে নিরাশ করেননি।

বাক-স্বাধীনতার খাঁচা

পাখি দুই রকমের, একটা উড়তে পারে আরেকটা উড়তে পারে না। যারা উড়তে পারে না, তারা আবার খুব জোরে দৌড়াতে পারে। কোন না কোন ভাবে তাকে খাবার এবং আত্মরক্ষার ব্যবস্থা প্রকৃতি করে দিয়েছে। 

এরা স্বাধীন পাখি। এদেরকে তোতা পাখির মত কথা শেখানো কঠিন বিষয়। কাছে গেলেই এরা উড়ে যায়। গাছের উঁচু ডাল থেকে নানা সুরে ডাকডাকি করে। মানুষের তোয়াক্কা করে না। আপনার শেখানো বুলি কোনভাবেই সে বলবে না। এরা বাকস্বাধীনতা উপভোগ করে।

কিছু পাখি আছে মানুষের খাঁচায় বসবাস করে। মূলত নিজের শখ পূরন করার জন্যই মানুষ তাকে বন্দী বানায়। নিজের মত খাবার দেয়, রংবেরঙের খাঁচা বানায়, বুলি শেখায়। তারপর জীবে প্রেম করেছে ভেবে খুব আহ্লাদ বোধ করে।

খাঁচার পাখি মাঝে মধ্যে ডানা ঝাঁপটায়, কপট রাগ দেখায়। কিন্তু তাকে তাই বলতে হয় আর করতে হয় যতটুকু তার খাঁচার মালিকের ইচ্ছা হয়। আর মাঝে মধ্যে শেখানো বুলি আওড়ে সে মালিককে খুশি রাখার চেষ্টা করে, যাতে ভালো খাবার পাওয়া যায়। এরা হচ্ছে বাক-পরাধীন পাখি। ডাকতে পারলেও খাবারের জন্য শেখানো বুলি বলতে হয় তাকে। নিজের ভাষার বদলে তাকে অন্য ভাষা রপ্ত করতে হয়।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে এই খাঁচায় বন্দী পাখির মতন। এরা মাঝে মধ্যে ডানা ঝাপটে কপট স্বাধীনতা উপভোগ করলেও মূলত বন্দী জীবন যাপন করে। সরকারের সীমার মধ্যে থেকেই সুশীলতা দেখায় আর নীতির চর্চা করে।

আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে, কেন আমাদের দেশের সাহিত্যিকেরা বিশ্বজয়ী সাহিত্যকর্ম তৈরি করতে পারে না? কারন বন্দি থাকা অবস্থায় তার আকাশে ওড়াওড়ি বন্ধ। কলমের গণ্ডি বেঁধে দেয়া আছে। কি লিখতে পারবে আর পারবে না সেটা যদি সীমারেখা টেনে দেয়া থাকে তবে সেখানে সাহিত্য চর্চা হয় না। যেটা হয় সেটা বাচ্চাদের গরু রচনা লেখার মত।

কিছু গৃহপালিত কবি-সাহিত্যিক অবশ্য প্রেমের গল্প আর কবিতা লিখেই জীবন পার করে দেয়। সমাজের দর্পন হবার বদলে তারা মিনমিনে সাহিত্য রচনা করে নারীকুলের ভালোবাসা অর্জন করে।

আবার কেউ কেউ যা হচ্ছে তা বলতে না পারার এই অদম্য বেদনায় পালিয়ে যায়, পৃথিবীর  অন্যপ্রান্তে গিয়ে নির্বাসিত জীবন যাপন শুরু করে।

বাক-স্বাধীনতার চর্চা করার জন্য বাংলাদেশ কখনোই উপযুক্ত ছিলো না।এখানে কবি-সাহিত্যিকের কলমকে ক্ষমতাসীনরা চরম ভয় পায়। সংবাদপত্রে কোনটা প্রকাশ হবে আর লেখকেরা কি লিখতে পারবে সেটা যদি ঠিক করে দেয়া থাকে তবে সেখানে উৎকৃষ্ট চিন্তার প্রতিফলন হয় না।

আমাদের দেশে অবশ্য জনগনই অনেক সময় এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। লেখালেখির জন্য এখানে হামলা, মামলা এবং শেষ পর্যন্ত খুন করার নজীর আছে।

অথচ বয়ান বাজিতে সবাই বলে বেড়ায় খুব বাক-স্বাধীনতা উপভোগ করছি। গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীর ভীড়ে আসল লেখকেরা তাই হারিয়ে গেছেন। 

নয়ত অনেক আগেই আপনি পত্রিকা আর ফেইসবুক ভরা দেখতেন, "যা হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে না"। লেখকেরা যদি সমালোচনা না করতে পারেন সমাজের, তবে সেই সমাজ পরিবর্তনের আশা করাটা বাতুলতা।

অপ্রিয় সত্য কথা বলতে পারাটাই বাক স্বাধীনতা। আপনার যা পছন্দ শুধু তাই যদি বলে যান লেখকেরা, তবে সেটা সৃষ্টিশীল নয়। সেখানে উঁচু মানের সাহিত্য রচনা হবে না।

এই চর্চা এদেশে আদৌ হচ্ছে কি? লেখককে প্রানে মেরে ফেলার হুমকি না দিয়ে এদেশের মানুষ কি তাদের লেখা পড়তে বা সমালোচনা শুনতে প্রস্তুত?